কেন্দ্র না রাজ্য এক দশক ধরে টানাপোড়েনের পরে আইপিএল-এ স্পট-ফিক্সিংয়ের ধাক্কায় অবশেষে নড়ে বসল কেন্দ্রীয় সরকারই। শুধু ক্রিকেট নয়, সব খেলাতেই অসৎ কাজকারবার রুখতে এ বার পৃথক আইন তৈরির সিদ্ধান্ত নিল মনমোহন সিংহের সরকার। কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী কপিল সিব্বল আজ জানান, বর্তমানে ম্যাচ-ফিক্সিং বা স্পট-ফিক্সিংয়ের মতো বেআইনি কাজ কোনও আইনের আওতায় পড়ে না। ভারতীয় দণ্ডবিধির সংশোধন করে এই সব অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াই যেত। কিন্তু তার বদলে খেলার জগতে সব রকমের অপরাধকে এক ছাতার তলায় এনে আলাদা আইন তৈরি হবে। ম্যাচ-ফিক্সিং, স্পট-ফিক্সিং, বুকিদের সঙ্গে যোগ, এমন কোনও অঙ্গভঙ্গি বা আচরণ যাতে খেলার পুরো বা আংশিক ফল বদলে যেতে পারে, এমন সব অপরাধই নয়া আইনের আওতায় আসবে। বিদেশি খেলোয়াড়, খেলার সঙ্গে জড়িত বেসরকারি সংস্থা, বুকি ও অন্য অপরারীদেরও নয়া আইনেই বিচার হবে।
নতুন আইন কবে থেকে কার্যকর হবে? আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন, তিন-চার দিনের মধ্যেই খসড়া আইনটি তৈরি হয়ে যাবে। তার পরে সেটি ক্রীড়া মন্ত্রক ও বিশেষজ্ঞদের কাছে মতামতের জন্য পাঠানো হবে। তার পরে সেটি সংসদে পেশ করা হবে। সিব্বলের কথায়, “সংসদের বাদল অধিবেশনেই বিলটি আনার চেষ্টা হবে।” তবে শ্রীসন্তদের স্পট-ফিক্সিংকে কেন্দ্র করে বর্তমান আইপিএল-কেলেঙ্কারির কোনও অপরাধ ওই আইনের আওতায় পড়বে না। কারণ প্রথা অনুযায়ী, নতুন আইনের আওতায় পুরনো অপরাধ পড়ে না। নতুন আইনে কোন ধরনের অপরাধে কী শাস্তি হবে, তা অবশ্য এখনও ঠিক হয়নি।
তবে বিলে যতটা সম্ভব বিস্তারিত ভাবে খেলাধুলো সংক্রান্ত অপরাধের তালিকা থাকবে। সার্বিক ভাবে অসৎ আচরণের সংজ্ঞাও তৈরি হবে। আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে যে সব অপরাধ করা সম্ভব, সেগুলিও এর আওতায় আনা হবে। কিন্তু নতুন আইন করতে গেলে রাজ্যগুলিকেও সঙ্গে নিয়ে চলা প্রয়োজন। অন্য দিকে ক্রীড়ামন্ত্রী জিতেন্দ্র সিংহের বক্তব্য, রাজ্যগুলির সঙ্গে তিনি ইতিমধ্যেই কথা বলেছেন। সব রাজ্যই চায়, কেন্দ্রই এ নিয়ে আইন করুক।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে অন্য জায়গায়। খাদ্য সুরক্ষা, জমি অধিগ্রহণ-পুনর্বাসন বিলের মতো কংগ্রেসের কাছে রাজনৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিলগুলিই এখনও পাশ করিয়ে উঠতে পারেনি সরকার। আর্থিক সংস্কারের বিলগুলিও আটকে রয়েছে। তার মধ্যে এই বিলটি কী ভাবে পাশ হবে, সংশয় তা নিয়ে। তবে বিসিসিআই-এর সহ-সভাপতি তথা রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা অরুণ জেটলিও এই আইনের পক্ষে। তাই বিল পাশ করাতে সমস্যা হবে না বলেই কেন্দ্রের আশা।
ইউপিএ-সরকারের শীর্ষ সূত্রের বক্তব্য, বিল যখনই পাশ হোক, কেন্দ্রীয় সরকার যে স্পট-ফিক্সিংয়ের মতো কেলেঙ্কারি ঠেকাতে সক্রিয়, সেই বার্তাটা দেওয়া প্রয়োজন ছিল। এমনিতেই ইউপিএ-সরকার একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগে জেরবার। আইপিএল-এর অন্যতম কর্তা হিসেবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাজীব শুক্ল থাকায় সরকারের অস্বস্তি বেড়েছে। অবশ্য সরকারের এটাও স্বস্তি যে, আইপিএল ও বিসিসিআই-এর সঙ্গে প্রায় সব দলের নেতাদেরই যোগ রয়েছে।
তাই কেউই এ নিয়ে একে অন্যকে আক্রমণ করছে না। গত কাল সিব্বলের সঙ্গে রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা তথা বিসিসিআই-এর সহ-সভাপতি অরুণ জেটলি ও রাজীব শুক্লর কথা হয়। জেটলি আবার বিসিসিআই-এর শৃঙ্খলারক্ষা কমিটিরও চেয়ারম্যান। অ্যাটর্নি জেনারেল বাহানবতীও সেখানে ছিলেন। তিনিও পৃথক আইনের পক্ষেই মত দেন। তার পরেই আজ নতুন আইনের কথা ঘোষণা করা হয়।
তবে সরকারকে বিঁধতে ছাড়ছেন না অনেকেই। বহু দিন ধরেই ক্রিকেট-জুয়া ঠেকাতে কড়া আইনের কথা উঠলেও এত দেরিতে তা হচ্ছে কেন, সে প্রশ্নও উঠছে।
বর্তমানে যে সব আইন রয়েছে, সেগুলিকে কাজে লাগিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কেন, সেই প্রশ্নও উঠছে। সিব্বলের বক্তব্য, সমস্যাটা ছিল যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো নিয়ে। খেলাধুলোয় অপরাধ রুখতে আইন তৈরির ক্ষমতা কেন্দ্রের রয়েছে কি না, সেটাই ঠিক করা যায়নি। কারণ সংবিধান অনুযায়ী, খেলাধুলো ও বেটিং-জুয়া দু’টিই রাজ্যের আওতায়। এ ছাড়া কেন্দ্রের আওতাধীন বা কেন্দ্র-রাজ্য যৌথ তালিকার কোথাও খেলাধুলো সংক্রান্ত অপরাধের কোনও উল্লেখ নেই।
এত দিন যে জট খুলছিল না, এখন তার সমাধান মিলল কী ভাবে? অ্যাটর্নি জেনারেলের মতে, স্পট-ফিক্সিং, ম্যাচ-ফিক্সিং, বুকিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, টিমের মালিকদেরই জুয়ার কারবারে জড়িয়ে পড়া, এ সব কোনও ভাবেই খেলাধুলোর সংজ্ঞায় পড়ে না। সিএবি (ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েন অব বেঙ্গল)-এর মামলাতেও সুপ্রিম কোর্ট এ কথা স্পষ্ট বলে দিয়েছিল।
আবার স্পট-ফিক্সিং বা ম্যাচ-ফিক্সিং কোনও ভাবেই বেটিং এবং গ্যাম্বলিং বা জুয়ার আওতায় পড়ে না। কারণ জুয়া চলে ভাগ্যের উপর। কেউ যদি জুয়ায় জিততে খেলার ভাগ্যই বদলে দেওয়ার চেষ্টা করেন ও তার জন্য টাকা দিয়ে খেলোয়াড়দের প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন, তা হলে সেটা আর বেটিং-জুয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। সেটা অন্য অপরাধ এবং তাই পৃথক আইনের প্রয়োজন।
এত দিন স্পট-ফিক্সিং বা ম্যাচ-ফিক্সিং বলে কোনও অপরাধের উল্লেখ ভারতীয় দণ্ডবিধিতে ছিল না। সাধারণত প্রতারণা, জালিয়াতির মতো অপরাধে এই সব মামলায় অভিযুক্তদের
বিচার হত।
|