কেয়ার্নস বিমানবন্দরে নেমে সবে নিজের সুটকেসটা কনভেয়র বেল্ট থেকে তুলেছি। পিছনে একটি নারীকণ্ঠ: ‘হাই দেব, ওয়েলকাম টু ট্রপিকাল অস্ট্রেলিয়া।’ আসার আগে যে কাগজ আমাদের দেওয়া হয়েছিল তাতে দেখেছি, উত্তর কুইন্সল্যান্ডের কেয়ার্নস-এ যে তিন দিন থাকব, আমাদের দেখভাল করবেন রস হ্যারিস। তিনি পুরুষ না নারী তা জানা ছিল না। অভ্যর্থনা শুনে ফিরে তাকাতেই এক প্রবীণা হাত বাড়িয়ে দিলেন, ‘রোজ। রোজালিন হ্যারিস।’
গাড়িতে উঠে কথা শুরু করলেন রোজ। সংসারের কথা। ইঞ্জিনিয়ার স্বামী, ছেলে, ছেলের বউ, দুই নাতি। একটি নামী হোটেলের মার্কেটিং ম্যানেজার হিসেবে পর্যটকদের সামলানোর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। সেই অভিজ্ঞতাই কাজে লাগাচ্ছে পর্যটন দফতর। বিদেশি সাংবাদিকদের এই এলাকার সঙ্গে পরিচয় করানোর ভার পেয়েছেন।
বাড়ি শহরতলিতে। কিন্তু একেবারে সুটকেস নিয়ে এসেছেন সঙ্গে। বললেন, ‘এই তিন দিন তোমাদের সঙ্গেই এক হোটেলে থাকব। না হলে তোমাদের অসুবিধা হতে পারে। সারা দিন ঘুরে তোমাদের মনে প্রশ্ন এলে আমাকে খুঁজতে হবে না। তাই তোমাদের সঙ্গেই থাকব।’
বিমানবন্দর থেকে গাড়ি ক্যাপ্টেন কুক হাইওয়ে ধরল। চিরহরিৎ অরণ্য চারিদিকে। কিছুটা এলাকা ঘিরে মাঝে মাঝে তৈরি হয়েছে সাফারি পার্ক। রোজ আমাদের নিয়ে গেলেন এমনই একটা সংরক্ষিত অরণ্যে। |
নাম কেয়ার্নস ট্রপিকাল জু। সাদর অভ্যর্থনা জানালেন এক মহিলা। অ্যাঞ্জেলা ফ্রিম্যান। চিড়িয়াখানার ডিরেক্টর, মার্কেটিং। রোজ জানালেন, ‘অ্যাঞ্জেলার শাশুড়ি এই চিড়িয়াখানার মালিক। এখন পুরো দায়িত্বটাই সামলাচ্ছেন অ্যাঞ্জেলা।’ এক মহিলা চিড়িয়াখানা চালাচ্ছেন! অ্যাঞ্জেলা মনের কথাটা ধরে বললেন, ‘আমার স্বামীর অন্য ব্যবসা রয়েছে। আমি এখানে পশুপাখি, গাছপালা নিয়ে বেশ আছি।’ অ্যাঞ্জেলা আমাদের যাঁর হাতে সঁপে দিলেন তাঁর নাম স্টেফি। ওই চিড়িয়াখানার কিপারদের প্রধান। বিশাল কুমিরকে মাংস ছুড়ে দিতে দিতে স্টেফি হিসেব দিলেন, ‘কিপারদের শতকরা ৯০ ভাগই মহিলা। বলতে পারেন আমরাই চালাই এই ট্রপিক্যাল জু।’
বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে চিড়িয়াখানা দেখে ফিরে এলাম শহরে। হোটেলে মালপত্র রেখে সমুদ্রের ধারে। বিভিন্ন স্টিমার সংস্থার দফতর। একটির দরজা খুলে ঢুকলাম। ভিতর থেকে যিনি বেরিয়ে এলেন, তিনিও প্রবীণা। শ্যারন লিভিংস্টোন। বিগ ক্যাট গ্রিন আইল্যান্ড রিফ ক্রুজ, ডিরেক্টর সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং। রোজ বললেন, ‘শ্যারন না থাকলে আমাদের পর্যটন দফতর অনেকটাই কানা।’ পর দিন ক্রুজে চেপে গ্রিন আইল্যান্ড যাওয়ার সময়ে জাহাজঘাটে দেখলাম শ্যারনের দাপট। কোন ক্রুজে কত যাত্রী, তার মধ্যে কত জন আমিষ খান, কত জন সাঁতার জানেন না, কার শারীরিক সক্ষমতা কতটা, সব তাঁর ঠোঁটস্থ। ‘ম্যাডাম বাড়ি থেকে রোজই হোমওয়ার্ক করে আসেন। কাজে কোনও ফাঁকি পাবেন না’, উচ্ছ্বসিত ক্রুজ সংস্থার সেকেন্ড অন কমান্ড জেনিথ। পরে দেখেছি, আমরা যে ক্রুজে চেপে গ্রিন আইল্যান্ড গেলাম তার পুরো দায়িত্ব জেনিথের। তাঁর হোমওয়ার্কের প্রমাণ পেলাম আমাদের কিছুটা দূরে বসা এক উত্তর ভারতের দম্পতির কাছে মধ্যাহ্নভোজের সময় যখন ডাল এবং দইয়ের পাত্র নিয়ে গেলেন তিনি। আমাদের কাছেও এলেন। বারামুন্ডি মাছ, চিংড়ি দিয়ে খাওয়া সেরে ফেলেছিলাম। তাই ডাল, দই ফিরিয়ে দিলাম। রোজালিন অবশ্য ডাল দিয়ে দই মেখে খেয়ে উচ্ছ্বসিত।
সফরের শেষ পর্বে ডিনারে সঙ্গে দেখা হল এলিজাবেথ ওয়েব-এর সঙ্গে। নর্থ কুইন্সল্যান্ড পর্যটন দফতরের মার্কেটিং ম্যানেজার। বেশ কয়েক বার কাজে ভারতে গিয়েছেন তিনি। বললেন, ‘আপনাদের দেশে নারীকে মায়ের জায়গায় রাখা হয়েছে। কিন্তু সে ভাবে পুরুষদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে নিজেদের জায়গা করে নেওয়ার চ্যালেঞ্জ এখনও নিতে পারেনি ভারতের মেয়েরা। যেটা আমরা পেরেছি।’
পরের স্টপ সিডনি। আমাদের গাইড ডোনা নরটনলজ। স্বামী, দুই মেয়েকে নিয়ে সংসার। নিউ সাউথ ওয়েল্স-এর ফ্রিলান্স গাইড হিসেবে কাজ করেন। সিডনি শহরের কোন হোটেলে কোন খাবারটা ভাল পাওয়া যায়, কোন ওয়াইন শপের ওয়াইন একেবারে জেনুয়িন, ঠোঁটস্থ। সিডনিতে যে দিন পৌঁছলাম তার পরের দিন আমাদের যাওয়ার কথা সিডনি থেকে ১৯৭ কিলোমিটার দক্ষিণে পোর্ট স্টিফেন্স। প্রশান্ত মহাসাগরের ধারের এক ছোট্ট পর্যটন কেন্দ্র। বছরে দু’বার এখানে তিমি প্রেমীরা ভিড় জমান। কারণ এখানকার সমুদ্র তিমির যাতায়াতের পথ। কথা ছিল, একটা গাড়ি ভাড়া করে আমাদের সেখানে নিয়ে যাবেন ডোনা। আমরা খেয়েদেয়ে হোটেলের বাইরে মালপত্র নিয়ে অপেক্ষা করছি, ঠিক সময়ে এলেন ডোনা। গাড়ি চালিয়ে। জানিয়ে দিলেন, ‘আমিই গাড়ি চালাব। আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস।’ গাড়িতে উঠে জানতে পারলাম পোর্ট স্টিফেন্সের রাস্তাটা ঠিক জানা নেই ডোনার। ব্যাগ থেকে একটা যন্ত্র বের করলেন। জুড়ে দিলেন গাড়িতে। কোথায় যাবেন সেই ঠিকানা লিখে দিলেন টাইপ করে। বললেন, ‘এটা জি পি এস সিস্টেম।’ গাড়ি চলতে লাগল আর প্রতিটি বাঁকের মুখে জি পি এস যন্ত্র পথনির্দেশ দিতে থাকল, ‘বাঁ হাতের প্রথম টার্নিংয়ে ঘুরে অমুক রাস্তা ধর, সোজা অন্তত পাঁচ কিলোমিটার গিয়ে পরবর্তী বাঁক পাবে।’ এই ভাবে সাড়ে তিন ঘণ্টায় পোর্ট স্টিফেন্স। সকাল থেকে সিডনি শহরে চক্কর কেটেছি। গাড়িতে ঢুলছিলাম। ডোনা কিন্তু অচঞ্চল। সকাল থেকে আমাদের সঙ্গেই ঘুরেছেন। সাড়ে তিন ঘণ্টায় এক বারই থামলেন রাস্তায়। আমাদের কফি খাওয়াতে। পোর্ট স্টিফেন্সের যে হোটেলটায় আমাদের রাখা হল তার ম্যানেজার থেকে ওয়েটার সবাই মহিলা। অভ্যর্থনা জানালেন ম্যানেজার লরেল। ডিনারে হোটেলের লরেল আমাদের টেবিলে একটি নামী ব্র্যান্ডের ওয়াইনের বোতল রেখে গেলেন। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের উপহার।
পরের দিন ডলফিন দেখতে যাওয়ার কথা। জেটিতে অপেক্ষা করছিলেন শ্যারন। পোর্ট স্টিফেন্স পর্যটন দফতরের কর্তা শ্যারন টারলে। ওঁর আসার কথা ছিল না। বললেন, ক্রুজের কর্মীরা আমাদের ঠিকঠাক সব বোঝাচ্ছেন কি না, আমাদের প্রশ্নের যথাযথ জবাব দিচ্ছেন কি না, তা দেখতেই তিনি সশরীরে হাজির হয়েছেন। আসল কথাটা জানা গেল সফরের পরে। আমাদের শ্যারন নিয়ে গেলেন কাছের মাছ বাজারে। বললেন, “তোমাদের লাঞ্চের ব্যবস্থা করা হয়েছে ওখানে। সমুদ্র থেকে মাছ ধরা হচ্ছে আর ভাজা হচ্ছে, যত খুশি খাও। কিন্তু কোথায় গেলে একেবারে ফ্রেশ পাবে, তা তোমরা বুঝতে পারবে না। তাই আমি এলাম।” শনিবার দুপুরটা তাঁর নিজের পরিবারের সঙ্গে কাটানোর কথা ছিল। তার বদলে টানা চারটি ঘণ্টা কাটিয়ে গেলেন, স্রেফ আমাদের সুবিধার জন্য।
যত দিন অস্ট্রেলিয়া ছিলাম, নিজের মোবাইল খুলিনি। ফেরার দিন সিডনি বিমানবন্দরে এসে মোবাইল খুলে দেখলাম যাবতীয় মেল, মেসেজ জমে রয়েছে। কলকাতায় নারী দিবস পালনের হরেক নিমন্ত্রণ। অস্ট্রেলিয়ায় সাত দিন কাটিয়ে দেখলাম নারী দিবস নিয়ে কোনও উন্মাদনা নেই। অনুষ্ঠান নেই। |