পৃথিবী জুড়িয়া ভিডিয়ো গেম-এর জনপ্রিয়তা গগনচুম্বী। তাই সেগুলি অধিক আকর্ষক ও ক্রেতা-মনোরঞ্জক করিয়া তুলিবার জন্য সাম্প্রতিক ঘটনার মশল্লা ছড়াইয়া সমৃদ্ধ করিবার প্রবণতা ভূরি ভূরি। এই বার ফ্রান্সে নূতন ভিডিয়ো গেম আসিল: ‘কিল মিত্তল’, বা, ‘মিত্তলকে হত্যা করো’। ভারতীয় অনাবাসী ব্যবসায়ী লক্ষ্মী মিত্তল গত ডিসেম্বরে ফ্রান্সের ফ্লঁর্যাজ-এ তাঁহার ইস্পাত কারখানাটি বন্ধ করিয়া দেন। বহু শ্রমিক কর্মহারা হন। তাহা লইয়া যথেষ্ট অসন্তোষ বহু স্তরে ঘনায়; ফরাসি রাষ্ট্রপতি ওলাঁদ হুমকি দেন, কারখানাটির জাতীয়করণ করিয়া লইবেন। উত্তরে মিত্তল ফ্রান্সে তাঁহার সকল উদ্যোগ বন্ধ করিয়া দিবার হুমকি দেন, তাহাতে প্রায় বিশ সহস্র শ্রমিক কর্মহারা হইতেন। আবার তিনি ফ্লর্যাঁজ-শ্রমিকদের অন্যত্র বহালের প্রতিশ্রুতি দেন। ফ্রান্সের শিল্পমন্ত্রী সক্ষোভে টেলিভিশনে বলেন, ‘মিত্তল ব্ল্যাকমেল করিতেছেন, মিথ্যা বলিতেছেন। আমরা উঁহাকে ফ্রান্সে চাই না।’ আন্দাজ করা যায়, এই আবেগ আরও বহু ফরাসি মানুষ বহন করিতেছিলেন। এই ঘৃণারই প্রকাশ ঘটিল নূতন ভিডিয়ো খেলাটিতে, যেখানে পর্দায় প্রথমেই ফুটিয়া উঠে: ‘সাল ২০৩০। সমগ্র পৃথিবী জুড়িয়া মিত্তল অধিকাংশ ইস্পাত কারখানাই বন্ধ করিয়া দিয়াছেন, হাজার হাজার মানুষ রুজি হারাইয়াছেন। এই সকল মানুষের নিকট, সকল প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘিত ও সকল মধ্যস্থতা ব্যর্থ হইবার পর, একটিই সমাধান: মিত্তলকে হত্যা করা।’ |
খেলায়, প্রথমে ফ্লর্যাঁজ-এর কারখানার সম্মুখে প্রহরারত পুলিশকে পিপে ও পাথর ছুড়িয়া ছত্রভঙ্গ করিতে হইবে, তাহার পরে, রোবট-রূপধারী মিত্তলকে প্রহার করিয়া হত্যা করিতে হইবে। অনেকে এই খেলার তীব্র নিন্দা করিয়া বলিয়াছেন, ইহা ফ্রান্সের ট্রেড ইউনিয়নের জঙ্গিপনার কথা ফলাও করিয়া ছড়াইতেছে, তাহাতে ফরাসি শিল্পক্ষেত্রের ভাবমূর্তি নষ্ট হইবে। কেহ বলিয়াছেন, ইহাতে সকল কর্তৃপক্ষকে ধরিয়া পিটাইবার আহ্বান করা হইতেছে মাত্র।
খ্যাতির অনেকগুলি মূল্য চুকাইতে হয়, তাহার মধ্যে একটি: মানুষটির কীর্তি সম্পর্কে কিছু না জানিয়াই বহু লোক তাঁহাকে শ্রদ্ধা করে। আর একটি: মানুষটির কীর্তি সম্পর্কে সম্যক না জানিয়াই বহু লোক তাঁহাকে ঘৃণা করে। মিত্তলের ন্যায় প্রভাবশালী ও প্রতিপত্তিশালী শিল্পপতি এই পৃথিবীতে অধিক প্রশস্তি পাইবেন না, কারণ পৃথিবী দরিদ্র ও বঞ্চিত মানুষে পরিপূর্ণ। তাহার উপর ফ্রান্সের আমজনতার নিকট তাঁহার মূল পরিচয়টি চাকুরিনাশী হিসাবে। আজিকার প্রযুক্তি কোনও রূপ প্রেম বা ঘৃণাকেই সহজে ছাড়িয়া দেয় না। নিজ আবেগটিকে লইয়া টুইট করিয়া, ইউটিউব ভরিয়া, এমএমএস ছড়াইয়া, নিজ সুখ-দুঃখ-মতামতের বিকট ও প্রকট প্রদর্শনী করিয়া, নিংড়াইয়া উদ্যাপন করিয়া, তবে আধুনিক মানুষ শুইতে যায়। ফলে এই ভিডিয়ো গেম আকাশ হইতে পড়ে নাই। ইহা বর্তমান চর্যার একটি অঙ্গ। তাহা না হইলে, সরাসরি এমন প্ররোচক নামকরণ করিয়া খেলা বাজারে ছাড়িবার সাহস হইত না। আবার, মিত্তল বা জর্জ বুশ, পুতিন বা তালিবান পাণ্ডা, সকলের ‘কালো হাত’ ভাঙিবার ও গুঁড়াইবার দৃঢ় অঙ্গীকারের কথা তারস্বরে জানাইয়া প্রবল মিছিল করা যাইলে, একটি খেলাই বা তেমন আন্দোলনবাচক মনোভাব লইয়া বানানো যাইবে না কেন? ইহাকে সমাজতন্ত্রের জয় বলিয়াও তো চিহ্নিত করা যাইতে পারে, নিদেন পুঁজিবাদের রমরমা রাজ্যে সমাজতন্ত্রের পা টিপিয়া প্রবেশ! তাহা আরও স্পষ্ট হয়, যখন খেলাটির শেষে, মিত্তল-পরাজয় সম্পূর্ণ হইবার পর, পর্দায় ফুটিয়া উঠে: ‘মিত্তল হত হইলেও, অচিরেই হুবহ অমনই এক জন তাঁহার গদিতে বসিবে।’ |