চার বছর আগের সকালটা এখনও বিভীষিকার মতো মনে পড়ে সারথি দাসের।
সকাল থেকেই আকাশ কালো করে ছিল। শুরু হয় প্রবল ঝড়-বৃষ্টি। হাওয়ার দাপটে কান পাতা দায়। সন্দেশখালির প্রত্যন্ত এলাকার বাসিন্দা সারথিদেবীর বাড়ি-ঘর ধুয়ে যায় বাঁধ ভাঙা জলে। বেশ কয়েকটা দিন কাটে ত্রাণশিবিরে। জলে-জঙ্গলে ঘেরা সুন্দরবনের মানুষ এমনিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু সে বার অভিজ্ঞতাটা ছিল সম্পূর্ণ অন্য রকম। সারথি আর তাঁর পরিবারের লোকজন বুঝে গিয়েছিলেন, এ বড় বিপদ।
আয়লা পরে তাঁরা জেনেছিলেন সেই বিপদের নাম। যে ঝড় কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সারথিদের মতো সুন্দরবনের হাজার হাজার মানুষের জীবনটাই বদলে দিয়েছিল।
আয়লার তাণ্ডবে জীবনহানি ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল অপরিসীম। কয়েকশো কিলোমিটার এলাকার নদীবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ দ্বীপভূমি। তাৎক্ষণিক ভাবে উদ্ধার ও ত্রাণের কাজ শুরু হলেও চার বছর পরেও সেই দুর্যোগের রেশ বহন করতে হচ্ছে সুন্দরবনের বহু মানুষকে। চাষবাসের প্রভুত ক্ষতি হয়েছিল আয়লায়। লবণাক্ত জল ঢুকে পরের কয়েক বছর চাষের জমির দফারফা হয়। মাছ চাষও ভয়ঙ্কর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। দুর্যোগ থামলেও জীবন-জীবিকার সমস্যায় পড়তে হয় হাজার হাজার মানুষকে। গ্রাম ছেড়ে কাজের খোঁজে অন্যত্র পাড়ি দেন অনেকে। ত্রাণ নিয়ে যথারীতি শুরু হয় দুর্নীতি। অনেকে এখনও আয়লায় ক্ষতিপূরণের টাকা পাননি বলেও অভিযোগ। |
সারথিদেবীরা এখনও বাড়ি ভাঙার ক্ষতিপূরণ পাননি। দিন কাটছে কলাগাছি নদীর বাঁধের উপরে। বললেন, “বহু তদ্বির করেছি প্রশাসনের দরজার দরজায়। কিন্তু প্রায় কিছুই মেলেনি।” বসিরহাটের মহকুমাশাসক শ্যামল মণ্ডল বলেন, “কমিটি গড়ে কাজ হচ্ছে। পুরো কাজ হয়নি। তবে চেষ্টা চলছে।” সমস্যা আছে আয়লা আক্রান্তদের মধ্যে বাধর্ক্যভাতার টাকা বিলি নিয়েও। হিঙ্গলগঞ্জের মনিকা দাস, দেবী গায়েন, বিরজা গোস্বামী, হরিপদ রায়েরা এখনও সেই টাকা পাননি বলে অভিযোগ। প্রচণ্ড অভাবে এলাকার অনেকে বিনা চিকিৎসা মারা যাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন কালীতলা পঞ্চায়েতের সদস্য নিতাইপদ রায়। টাকা বিলি নিয়ে সমস্যার কথা মানছেন প্রধান শ্যামলী মণ্ডলও। তবে চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
গোসাবার বাবু নস্করের কথায়, “চার বছর পেরিয়ে গিয়েছে। এখন আমরা ফের স্বাভাবিক জীবন শুরু করেছি। কিন্তু সুন্দরবনে নদীবাঁধের কাজ এখনও সর্বত্র শেষ হয়নি। আরও এক বার বর্ষা চলে এল। কখন যে এই এলাকায় কী ঘটে যায়, সব সময়েই আমরা ভয়ে ভয়ে থাকি। আয়লার পর থেকে সেই আতঙ্ক আরও বেড়েছে। বাড়ি-ঘর হারিয়ে দিনের পর দিন ত্রাণশিবিরের দিনগুলোর কথা মনে পড়লে এখনও গায়ে কাঁটা দেয়।”
সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে নদীবাঁধ তৈরির কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন দুই ২৪ পরগনার জেলা প্রশাসনের কর্তারা। একশো দিনের কাজে দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ম্যানগ্রোভ লাগানো হয়েছে নদী বাঁধ বরাবর। তা আয়লার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সহায়ক হবে বলে আধিকারিকদের আশা। বন্ধ হয়নি বাঁধ কেটে চাষের জমিতে জল ঢুকিয়ে মাছ চাষের প্রবণতাও। নদীবাঁধের পাশে ইটভাটার জন্যও বাঁধে ক্ষতি হচ্ছে। সে দিকেও এখনও নজর পড়েনি প্রশাসনের। আয়লা আক্রান্তদের জন্য ২ টাকা কেজি দরে চাল পেতেও সমস্যা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন এলাকায়।
|