অঞ্জন-ব্যঞ্জন
মিষ্টি কথার বিষ্টি
বাঙালির মনে কী থাকে জানি না, মুখে সব সময়েই মিষ্টি। অনেক দিন বাদে কারও সঙ্গে দেখা, মনে-মনে হয়তো জ্বলছে, বলছে এই পোড়ারমুখো-র সঙ্গেই দেখা হতে হল, মুখে কিন্তু একগাল মিষ্টি হাসি, আমার ছোটমামা যাকে বলতেন, মুখ থেকে যেন নকুড় ঝরে পড়ছে! বাঙালি আর মিষ্টি সমার্থক। বারো মাসের ষোলো পার্বণে মিষ্টির ঢালাও সাম্রাজ্য বিস্তার। পশ্চিমবঙ্গের যে কোনও পাড়ার দিকে তাকান, নিদেনপক্ষে একটা মিষ্টির দোকান থাকবেই! যেখানে বাঙালি, সেখানে মিষ্টি। গুয়াতেমালায় তিন জন বাঙালি একজোট হলে, তার মধ্যে এক জন অন্তত একটা মিষ্টির দোকান খুলবেই, এটা খুব পরিষ্কার হিসেব।
আমি যখন মুম্বইয়ে প্রথম ‘সুইট বেঙ্গল’ খুলি, বহু প্রবাসী বাঙালি আমাকে দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করেছিলেন। শুধু তাই নয়, বহুদিন কার মুম্বইকরেরাও আস্তে আস্তে বাংলার মিষ্টির ফ্যান হয়ে গেছেন। সবচেয়ে বড় অ্যাম্বাসাডর তো অমিতাভ বচ্চন। কত শত বার যে বচ্চনজির বাড়িতে বাংলার প্রতিনিধি হয়ে ‘সুইট বেঙ্গল’-এর মিষ্টি গেছে!
মিষ্টি ব্যাপারটা বাংলার একচেটিয়া। রসগোল্লার জন্ম থেকে সন্দেশের রমরমা, সবই কিন্তু বাঙালির হাত ধরে। আর কোন রাজ্যে বলুন তো, সন্দেশের মতো এমন একটা ইনোভেশন হয়েছে? আর তার ভেরিয়েশন? জাস্ট, জবাব নেই। সবচেয়ে বড় কথা মিষ্টির এই ট্র্যাডিশনটা কিন্তু ট্র্যাডিশনেই আটকে নেই, সমকালীনতার রসে তার সমান আসক্তি। সাধে কি বেকড রসগোল্লা বা ডায়াবিটিক সন্দেশের আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা? আজ যে মিষ্টি খায়, আর যে মিষ্টি খায় না, দু’জনের কাছেই পর্যাপ্ত অপশন। মিষ্টি যে আজ কেক বা পেস্ট্রির মতোই আধুনিক, তার পিছনে বাংলার পাল্টে যাওয়া রুচির স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি।
আর একটা ব্যাপার মিষ্টির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত। ইতিহাসের পাশাপাশি মিষ্টির ভূগোল। শক্তিগড়ের ল্যাংচা কিন্তু বর্ধমানের নয়। ঠিক যে রকম বর্ধমানের মিহিদানা বা সীতাভোগ রানাঘাটের নয়। রানাঘাট স্বখ্যাত তার পান্তুয়াকে ঘিরে। আবার জলপাইগুড়ির লালমোহন কিন্তু রানাঘাটের পান্তুয়া নয়। ঠিক যেমন শান্তিপুরের নিকুতি আর কালনার গুজিয়ার মধ্যে আকাশপাতাল তফাত। মিষ্টির ভূগোল তাই বিচিত্রগামী।
মিষ্টির সামাজিক তাৎপর্যও অনন্য। বাড়িতে হঠাৎ কেউ এলে তাকে জলের সঙ্গে মিষ্টি দেওয়া বাঙালির বহু দিনের প্রথা। অন্য কোনও জাতিতে এমন রীতি আছে কি না জানা নেই। বাঙালিবাড়িতে পাশ করলে মিষ্টি, অফিসে প্রোমোশন পেলে মিষ্টি, বিয়েতে মিষ্টি এমন কি সৎকার-শেষে শ্মশানযাত্রীদের জন্যও মিষ্টি। মিষ্টি সর্বকাজে, সর্বঘটে।
মিষ্টির রকম নিয়ে ঘটি-বাঙাল মতভেদ সুপরিচিত। ঘটিদের সব রান্নায় মিষ্টি যেমন, বাঙালের সব রান্নায় তেমন মার-মার-কাট-কাট ঝাল। এক জনের রান্না মুখে দিলে হাসি, অন্য জনের রেসিপিতে চোখে জল এসে যায়। কত অখ্যাতনামার হাতে এই দুই বাংলা মিষ্টির প্রচার ও প্রসার হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। মালপো শুধুই ও পার বাংলার মিষ্টি কি না জানি না, তবু ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে ‘মাসিমা, মালপো খামু’ সংলাপ কালজয়ী হয়ে আছে। মিষ্টির এমন রি-কল সত্যিই অসামান্য। আর একমাত্র বাঙালিই পারে এমন নিদান দিতে যে পেট খারাপেও গরম রসগোল্লার কোনও জুড়ি নেই।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.