ব্যাগ গুছিয়ে...
চিতওয়ানেই আনন্দ
গাঢ় হলদে ফগ লাইটের জোরালো আলোয় ঘন কুয়াশার আস্তরণ ভেদ করে এগিয়ে চলেছে আমাদের জোঙ্গাটা। হুড খোলা জোঙ্গায় কুয়াশারা যেন ভেঙে পড়ছে প্রবল বিক্রমে। ঘড়িতে তখন সন্ধে সাতটা পাঁচ। হিমালয়ের তরাই অঞ্চলে ভর সন্ধেতেই ঘন কুয়াশা মাখামাখির কারণ বুঝতে বুঝতে পৌঁছে গেলাম সৌরাহা। তরাই জঙ্গলমহল। কুয়াশায় মিশেছে একটা বুনো জঙ্গলের গন্ধ। সৌরাহা থেকে বাঘমারা পৌঁছতে সময় লেগে গেল প্রায় আধঘণ্টা। গ্রাম শেষে জঙ্গলের শুরু।
জঙ্গলের মাঝে মাঝে ছোট ছোট ইকো কটেজ। এমনই এক গুম মেরে থাকা কটেজে রাত্রিবাস করব। কটেজটা সৌরশক্তির টিমটিমে আলোয় জঙ্গলের মাঝে ঠিক যেন একটা ‘ভূতবাংলো’র চেহারা নিয়েছে। রহস্যের মোড়ক জড়ানো ঘন কুয়াশারা গাছের পাতায় জমে টিপ-টুপ-টাপ। একটু এগিয়ে যেতেই নদীর বহতা কুল-কুল-কুল। হঠাৎ পাশের ঝোপে-জঙ্গলে কিছু একটা নড়াচড়া করছে বুঝতে পারলাম। টর্চ মারতেই জ্বলজ্বল করে উঠল দুটো চোখ। ঠিক যেন ঝলসে উঠল। আর কিছু বোঝার আগেই একটা ওয়াইল্ড জ্যাকল জঙ্গলের আরও গভীরে ঢুকে পড়ল। হ্যারিকেনের আলোয় ডাইনিং স্পেসে নীচের রাপ্তী নদীর গান শুনতে শুনতে ডিনার সেরে ফেললাম। নেপালের তরাই অঞ্চলে এই জঙ্গলের নাম ‘চিতওয়ান জাতীয় উদ্যান’।
১৯১১-য় নেপালের রাজার আমন্ত্রণে আসেন ব্রিটেনের রাজা পঞ্চম জর্জ ও পুত্র অষ্টম এডওয়ার্ড। সেই সময় প্রায় ৪০টি বাঘ ও ১৮টি একশৃঙ্গ গণ্ডার ওঁদের বন্দুকের গুলির শিকার হয়। ধীরে ধীরে বাঘের সংখ্যা কমতে শুরু করে। স্বাধীনতার পর শিকার নিষিদ্ধ হয়। ১৯৮৪ সালে ইউনেসকো চিতওয়ানকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’-এর মর্যাদা দেয়। প্রায় ৯৩২ বর্গ কিলোমিটার অরণ্যের আয়তন এখানে। এর মধ্যে সৌরাহার বাঘমারা অংশেই ঘুরতে পারেন পর্যটকরা। রাত জুড়ে জোনাকির মিটিমিটি হাসি এবং ঝিঁঝির সিম্ফনি।
পরদিন ভোর সাড়ে পাঁচটায় উঠে দেখি, সেই একই ঘন কুয়াশার আলোয়ান জড়ানো। একটু ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। ব্রেকফাস্ট সেরে দাঁড়িয়ে আছি, চলে এল জোঙ্গা জিপ। হলুদ সরষের খেত আর বাঘমারা কমিউনিটি ফরেস্ট বাফার জোন থেকে এলিফ্যান্ট সাফারি শুরু হয়। হাতির পিঠে চড়ে জঙ্গলের সাফারি। ঘন কুয়াশায় সবার মুখ ব্যাজার। সারি সারি হাতি পর্যটকদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। একটা হাতির পিঠে চার জন সওয়ারি। হাতির নাম মোতি। দুলকি চালে হাতির পিঠে কুয়াশা-মাখা রাস্তা নদী পেরিয়ে উঁচু ঘাসজমির পাশ দিয়ে চলেছি। একসঙ্গে পাঁচটি হাতি ঘাসজমি ছাড়িয়ে গভীর জঙ্গলে ঢুকে পড়ল। শালের জঙ্গলের আকাশ ছুঁতে চাওয়া গাছের ফাঁক দিয়ে জঙ্গল ফুঁড়ে আসছে ঘন কুয়াশার ধোঁয়া। গোটা চিতওয়ানকে এই কুয়াশা যেন আরও রহস্যময়ী করে তুলেছে। ‘চিতওয়ান’ মানে জঙ্গলের মধ্যভাগ।
ঘন কুয়াশার আড়ালে কোমর-সমান গাছের ফাঁকে একদল সম্বর নিশ্চিন্তে কচি পাতা চিবোচ্ছে। অল্প দূরেই ইন্ডিয়ান সিভেটের একটা পাল হাতি দেখে আবার জঙ্গলে ঢুকে পড়ল। হাতির পিঠে চেপে জঙ্গলের ঘন কুয়াশায় বন্য জন্তুদের পিছনে ধাওয়া করার রোমাঞ্চটাই আলাদা। জঙ্গলের অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা ভেদ করে এগিয়ে চলেছি। কুয়াশার কল্যাণে জঙ্গল সমানে সবুজ থেকে আরও সবুজ। গাছের পাতায় কুয়াশার জমা জল বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা হয়ে ঘাড়ে-মাথায় পড়তেই শরীরে যেন শিহরণ। হঠাৎ গাছের ডালে নজরে আসে ‘পার্পল সানবার্ড’। জঙ্গলের আবহে তখন একটানা ঝিঁঝির কনসার্ট।

একশৃঙ্গ গণ্ডার

স্নানবিলাসী হাতি
হাতের ক্যামেরাও সচল। হাতির পিঠে চেপে চলে এসেছি নারায়ণী নদীর পাড়ের বিস্তীর্ণ ঘাসজমিতে। স্থানীয়রা ‘ফান্টা’ নাম দিয়েছেন। আসলে ‘এলিফ্যান্ট গ্রাস’ নামে পরিচিত। ২০ ফুট পর্যন্ত ঘাসের উচ্চতায় দুলকি চালে হাতির পিঠে চলেছি। হঠাৎ শুঁড় তুলে একটা হুঙ্কার ছাড়ল। সকলের চোখ, ক্যামেরা সজাগ। একশৃঙ্গ গণ্ডার ও তার শাবক দিব্যি কাদাজমিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। তাদের ঘিরে রয়েছে সওয়ার-সমেত পাঁচটি হাতি। কিছুক্ষণ দর্শন দিয়েই আবার ঘাসজমিতে মিলিয়ে গেল চিতওয়ানের বিখ্যাত একশৃঙ্গ গণ্ডার। সব মিলিয়ে চিতওয়ানের শাল, শিমুল, শিশুর মাইলের পর মাইল বিছিয়ে থাকা জঙ্গলের বৈচিত্র যেন এক স্বপ্নের প্রশান্তি। হাতি সাফারি সেরে আবার কটেজে ফেরত এলাম। কুয়াশা সরিয়ে তখন সবে সূর্যের উঁকিঝুঁকি।
হাতির পিঠে সাফারির পর এ বার রাপ্তীর বুকে ক্যানোয়িং-এর পালা। সৌরাহা ক্যানোয়িং পয়েন্ট থেকে এক ধরনের লম্বা ডিঙিতে চড়ে বসলাম। চার জন বসার লম্বা সরু ডিঙি চলতে আরম্ভ করল রাপ্তীর বুক চিরে। নদীর দু’পারের জঙ্গলের হৃৎস্পন্দন, পাখির বৈচিত্র যেন ছায়াছবির মতোই সামনে ভাসছে। প্রায় ৪৫০ প্রজাতির পাখির স্বর্গদ্বার চিতওয়ানের জঙ্গলমহল। গালভরা সব নাম তাদের। দাঁড়-ছপাছপ নদীর বুকে হাজার পাখির মেলা। কুয়াশার জাল কেটে সূর্যের সোনা রোদে চিকচিক করছে রাপ্তীর বুক। আদ্যোপান্ত ধুলোমাখা হাতির দল ততক্ষণে নেমে পড়েছে রাপ্তীর বুকে। হাতিরা এত স্নানবিলাসী হতে পারে এটা জানা ছিল না। পরম যত্নে মাহুত তাদের স্নান করিয়ে দিচ্ছে। বিদেশি পর্যটকেরা হাতির পিঠে চড়তেই শুঁড় তুলে তাদের শরীর ভিজিয়ে দিচ্ছে। এটিও এই অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরেরই এক অঙ্গ বই কী! ইচ্ছে হলেই সামিল হওয়া যায়।

ক্যানোয়িং
ক্যানোয়িং সেরে ফেরার পথে দেখি ঘাসজমির ও পারের জঙ্গলটা যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। হাতি ছাড়াও জিপ-সাফারিতে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো যায়। সকালে ঘন কুয়াশার কারণে জঙ্গলটা ভাল ভাবে দেখা হয়নি। ঝলমলে আলোয় এ বারে জিপ সাফারিতে চললাম। দুপুরের চড়া রোদ মাথায় নিয়ে এগিয়ে চলেছি। গরম বাড়ছে। কুয়াশার ঘামে-ভেজা গাছের পাতা কখন রোদের তেজে শুকিয়ে গিয়েছে। ধুলো উড়িয়ে গাড়িটা এসে দাঁড়াল জঙ্গলের গভীরে একফালি জলাশয়ের সামনে। বেশ খানিকক্ষণ প্রতীক্ষার পরে একদল ‘হগ ডিয়ার’ আমাদের ক্যামেরার জন্য রীতিমতো যেন ‘পোজ’ দিয়েই জলাশয় থেকে জল খেল! ঘন পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো চুঁইয়ে আসছে। হরিণের দল বিদায় নিতেই জঙ্গলের ‘টায়ার মার্ক’ ফলো করে করে চলেছি আরও নতুন কিছু বন্য জন্তু দেখার আশায়। যত এগোচ্ছি, ততই জঙ্গল বাড়ছে। আলোছায়ার উল্লাসে পাখির ডাকে মুখরিত মহল্লায় একরাশ ধুলো উড়িয়ে আমাদের গতিরোধ করল একদল বিশালদেহী ‘ওয়াইল্ড বাফেলো’! দলের সর্দার গোটা র্যালির পুরোভাগে নেতৃত্ব দিচ্ছে। অন্তত কুড়ি-বাইশ জনের দল হবে। ফিসফিস করে গাইড জানালেন, “সাব, ইয়ে গ্যাং বহুত খতরনক হ্যায়! সাম্ভালকে! ইসি গ্যাং নে কুছ দিন সে গাঁও মে হামলা চলা রহা হ্যায়!” ওয়াইল্ড বাফেলো-র গ্যাং সরে যেতেই আমাদের জিপটা বাঘ বাহাদুরের দর্শনের আশায় আরও বেশ কিছুক্ষণ এ-দিক ও-দিক চক্কর মারল।
শোনা যায়, চিতওয়ানের জঙ্গলে বাঘ আছে বটে, কিন্তু তাদের অস্তিত্বের কথা স্বয়ং রেঞ্জার সাহেবও জানেন না। ফিরতি পথে আবার গাড়ি থামালেন ড্রাইভার। একদল বাঁদর হঠাৎই চিৎকার করতে করতে এ-ডাল থেকে ও-ডালে ঝাঁপ দিল! গাইড বললেন, “সাব, মাঙ্কি কল! জাস্ট ওয়েট।” গাছপালা মড়মড় করে ভাঙার আওয়াজও কানে এল। পাখিরাও চিল-চিৎকার জুড়েছে। বিশাল মাপের দুটি ‘টাস্কার’ ঠিক এই সময়ে শালবনের ডালপালা ভেঙে আমাদের একেবারে সামনে দিয়েই বীরদর্পে তাদের করিডর দিয়ে পাস করল।
এ বার আমাদের ফেরার পালা। একটা অদ্ভুত পরিতৃপ্তি সকলের চোখেমুখে। ঠিক যেন যুদ্ধ জয় করে ফিরছি! প্রত্যেকেরই চোখ জঙ্গলের আনাচে-কানাচে। বেলা শেষের এই ফেরার পথে যেন গোগ্রাসে জঙ্গলের রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধের সবটুকু নিংড়ে নিতে চাইছে মন। দুপুর গড়িয়ে তখন বিকেল। চিতওয়ান জঙ্গলের জাদুতে এত বেশি বুঁদ হয়ে ছিলাম যে, সারা দিনে যে প্রায় কিছুই খাওয়া হয়নি, তাও টের পাইনি! জঙ্গলের অনাবিল আদর-জড়ানো ক্লান্ত শরীরটা কটেজের সামনের রিভার-ফেসিং ডাইনিং স্পেসের চেয়ারে এলিয়ে দিয়ে, তাপ্তীপারের আকাশের সিঁদুর-রাঙা সন্ধ্যার শোভা উপভোগ করতে বসলাম!
ঝুপঝুপ করে এর পর সন্ধ্যা নামতেই কুয়াশার অশরীরী দেহ আবারও রহস্যের জাল বুনতে শুরু করেছে কখন। দেখতে দেখতে কটেজটা অবিকল যেন রহস্য-উপন্যাসের পাতায় পড়া কোনও পোড়ো বাড়ির রূপ ধারণ করল। জোনাকি-জ্বলা রাতের অন্ধকারে টিমটিমে আলোয় ডিনার সেরে স্বপ্ন-জড়ানো রাতের শেষে আরও একটা সুন্দর ভোরের অপেক্ষা।
আজ শেষ দিন চিতওয়ানের বুকে। এখানকার থারু উপজাতিদের গ্রাম না-দেখলে অনেকটাই অদেখা থাকবে চিতওয়ান। এখানকার ‘বাছাউলি’ গ্রামে প্রায় ৭০০ বছর ধরে বসবাস করেন থারু উপজাতির মানুষ। তবে অবাক হলাম তাঁদের মিউজিয়াম, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আর জীবনযাত্রা দেখে। আজকের পুরুষতান্ত্রিক সমাজেও তাঁরা পুরোপুরি মাতৃতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থায় বিশ্বাস করেন। মহিলারাই এঁদের সমাজে সবচেয়ে ক্ষমতাসীন। গ্রামের ‘দাইবুড়ি’ই হল সমাজের প্রধান।
কুয়াশা কেটে কাঁচা হলুদ রঙের রোদ তখন জাঁকিয়ে বসেছে সৌরাহার বাঘমারায়।

কী ভাবে যাবেন
কলকাতা থেকে ট্রেনে রকসৌল হয়ে নেপালের বীরগঞ্জ। সেখান থেকে বাসে অথবা
গাড়িতে চিতওয়ান। বীরগঞ্জ থেকে চিতওয়ানে যেতে সময় লাগবে ৪ ঘণ্টা।
কোথায় থাকবেন
সৌরাহার বাঘমারাতে থাকার অনেক কটেজ ও হোটেল রয়েছে।
প্রয়োজনীয় তথ্য
নভেম্বর থেকে এপ্রিল জঙ্গলে ঘোরার সেরা সময়। জঙ্গলে প্রতিটি জায়গায় আলাদা
আলাদা প্রবেশমূল্য লাগে। জঙ্গলে বেড়ানোর সময়ে উগ্র পারফিউম নেওয়া বা বেশি
হই-হুল্লোড় করা বারণ। প্রতি ক্ষেত্রে গাইডের পরামর্শ মেনে চলুন। রাপ্তী নদীতে প্রচুর
কুমির আছে। তাই স্নান করতে নামলে যে-কোনও মুহূর্তেই বিপদ ঘটতে পারে।
লেখা ও ছবি: শান্তনু চক্রবর্তী




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.