প্রশ্ন: আজ ক্লাবের পতাকা তোলার অনুষ্ঠানে গেলেন না কেন? বরাবর তো বিজয়োৎসবে যেতেন?
মর্গ্যান: কাল যে লোকটা গুড বাই বলে চলে এসেছে, সে আজ আবার ভিড়ের মধ্যে গিয়ে কী করবে? আমি ইচ্ছাকৃতই দূরে থাকতে চেয়েছিলাম। আর কোনও কারণ নেই।
প্র: ইস্টবেঙ্গল সাধারণ সচিব এ দিন আপনাকে কটাক্ষ করে বলেছেন, মর্গ্যান এ মরসুমে নতুন কী দিয়েছে? আপনার জবাব কী?
মর্গ্যান: তাই বুঝি? এ রকম বলেছেন? অবাক লাগছে। গত তিন বছর আমার সঙ্গে ওয়াকির্ং রিলেশনশিপ ছিল। এত বার কথা বলেছি। উনি যে আমার ব্যাপারে হতাশ সেটা তো সরাসরি আমাকেই বলতে পারতেন। মিডিয়ার কাছে চলে গেলেন কেন? আর আমি এ বছর নতুন কী দিয়েছি? তা, দিয়েছি ফেডারেশন কাপ। কলকাতা লিগ। আর ক্লাবকে ন’বছর পর এএফসি কাপের কোয়ার্টার ফাইনালে নিয়ে গিয়েছি। সত্যিই এর জন্য দুঃখিত!
প্র: আপনি স্বপ্ন-টপ্ন দেখেন?
মর্গ্যান: কেন বলুন তো?
প্র: কারণ পার্থের বিছানায় শুয়ে আপনি নির্ঘাত দুঃস্বপ্নে ইস্টবেঙ্গল সচিবকে দেখবেন? ওঁর সঙ্গে অনেক দিন ধরেই আপনার চলছে কিনা?
মর্গ্যান: ধ্যাৎ, পুরুষরা কি পুরুষদের চট করে স্বপ্নে দেখে নাকি?
প্র: কেন দেখবে না?
মর্গ্যান: আমি তা হলে চাইব, তেমন হলে আমার স্ত্রীও আমার স্বপ্নে আসুক। কিন্তু ওই লোকটা নয়।
প্র: শনিবার কখন প্লেন?
মর্গ্যান: রাত্তিরে।
প্র: এমন কাউকে না জানিয়ে চলে যাচ্ছেন?
মর্গ্যান: বেশি জানানো-টানানোর দরকার কী? জিতে শেষ করতে চেয়েছিলাম। মোহনবাগান ম্যাচটা হেরে গেলে শেষ দৃশ্যটাই ফ্যাকাশে হয়ে যেত। আমি নিজেকে জানি। পরের তিন-চার মাস ওটা যন্ত্রণা দিত।
প্র: বাংলায় একটা কথা আছে। সেটা হিন্দিতেও লোকে বলে অভিমানী। কাছাকাছি ইংরেজি করলে দাঁড়ায় ‘সেন্টিমেন্টাল’। আপনার চলে যাওয়াটা কি অভিমানী হয়েই ঘটল না?
মর্গ্যান: সিদ্ধান্তটা মোটেও সহজ ছিল না। বিশেষ করে কালকের ম্যাচের পর। কালকের পরিস্থিতিটা অস্ট্রেলিয়ায় এক বন্ধুকে আমি ফোনে বলছিলাম। একেবারে আনরিয়েল! কোনও কোচ যে এমন সম্মান পেতে পারে ভাবাই যায় না। পুরো ইস্টবেঙ্গল গ্যালারি কাল সমস্বরে ডাকছিল, ‘ম-র্গ্যা-ন, ম র্গ্যা-ন’। গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো আবেগ। কিন্তু কী জানেন, আবেগ দিয়ে তো জীবন চলে না। জীবনের বড় সিদ্ধান্তগুলো মস্তিষ্ক দিয়েই নিতে হয়। আমি এখানে যথেষ্ট এনজয় করেছি। সমর্থকেরা ভালবেসেছে। প্লেয়াররা সম্মান দিয়েছে। কিন্তু জীবনের এই একটা স্টেজে আমার এখন বাড়ি চলে যাওয়াই দরকার। এটা মোটেও ফুটবলীয় সিদ্ধান্ত নয়। ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। সবাই জিজ্ঞেস করছে, কোন ক্লাবে যাচ্ছি-কোন ক্লাবে যাচ্ছি? আসলে আমি বাড়ি যাচ্ছি।
প্র: কলকাতার কী কী মিস করবেন?
মর্গ্যান: সিটি সেন্টারটা আমার সেকেন্ড হোম হয়ে গিয়েছিল। এটা বাকি কলকাতার মতো নয়। বেশ প্রাইভেসি আছে। আর কলকাতার খাবারদাবারগুলো মিস করব। বিশেষ করে ভেজিটেরিয়ান ডিশগুলো। ভ্যারাইটি অনেক বেশি। আর ননভেজ ইন্ডিয়ান ফুডেরও অস্ট্রেলিয়ায় দাম অনেক বেশি প্লাস একগাদা মশলা দেয়। |
নতুন জীবন, নতুন বাহন। শুক্রবার দুপুরে ট্রেভর মর্গ্যান তো আর ইস্টবেঙ্গলের কোচ নন। ছবি: কৌশিক সরকার |
প্র: রান্নার মতোই লাল-হলুদ সমর্থকদের মিস করবেন না?
মর্গ্যান: সমর্থকদের প্যাশন কলকাতা ফুটবলের একটা দারুণ দিক। ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের তো কথাই নেই। দারুণ প্লাস। একই সঙ্গে ওটা আবার দারুণ মাইনাস হয়ে যায়। আমি সাপোর্টারদের একটাই কথা বলব। সাপোর্টই যদি করেন, আগাগোড়া করুন। একটা টিম যখন ভাল খেলে তখন তো সবাই সাপোর্ট করতে পারে। আসল পরীক্ষা হল, যখন টিমটা ভাল খেলছে না। তখন যেন ওঁরা ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে থাকেন।
প্র: আর কলকাতা ফুটবল মিডিয়া?
মর্গ্যান: উরি বাবা। উরি বাবা।
প্র: এত উরি বাবা করছেন কেন?
মর্গ্যান: ওরা সাংঘাতিক। আমি এ রকম কোথাও দেখিনি। শুনিওনি। পৃথিবীর কোথাও আছে বলে মনে হয় না।
প্র: কী বলছেন? ইতালি বা স্পেনে ওরা আরও আক্রমণাত্মক। আপনার দেশের ট্যাবলয়েড পেপারগুলোর কথা তো বাদই দিলাম।
মর্গ্যান: না, না। ওরা আরও আক্রমণাত্মক হতে পারে। এত ছিদ্রান্বেষী নয়। এরা অবিশ্বাস্য ডিমান্ডিং। সব সময় কিছু না কিছু খুঁচিয়ে যাচ্ছে। অমুক প্লেয়ার আপনার নামে এইমাত্র বলল। তা আপনি কী বলছেন? যেই মুখ খুলবেন একটা স্টোরি হয়ে গেল। আর কিছু দিনের জন্য আপনার টিমের বারোটা বাজিয়ে দিল। কন্টিনিউয়াস এ রকম ঢেউ আসতে থাকবে। আর সেটা সামলাতে হবে। তার পর প্র্যাক্টিসে রোজ ঢুকে পড়ছে। আপনি ট্যাবলয়েড বললেন তো? ট্যাবলয়েডেরও কিছু ব্যাকরণ আছে। কিছু প্যাটার্ন আছে। এখানে কোনও কিছুর বালাই নেই। সারাক্ষণ থেকে ছবি তুলে নিয়ে যাচ্ছে।
প্র: আপনার একার অধিকার থাকলে মিডিয়াকে ইস্টবেঙ্গল মাঠে রোজ ঢুকতে দিতেন না?
মর্গ্যান: হরগিস না। এ কি মামদোবাজি নাকি যে, আমার গোপন ছবি, আমার গোপন সব মুহূর্ত সবার সামনে আমি খুলেআম মেলে ধরব? এই যে চ্যানেলকে ঢুকতে দেওয়া। এর ফল কী জানেন? এক দিন ইউটিউব খুলে দেখি, আমার সমস্ত গোপন ফ্রি কিক মুভমেন্ট দিব্যি সেখানে শোভা পাচ্ছে। জিজ্ঞেস করে জানলাম, স্থানীয় চ্যানেলবাবুরা আপলোড করে দিয়েছেন। পৃথিবীর সর্বত্র প্র্যাক্টিসে প্লেয়ারে-প্লেয়ারে গণ্ডগোল। প্র্যাক্টিসে হাতাহাতি, কোচের সঙ্গে মনোমালিন্য এ সব হয়েই থাকে। আবার সেগুলো আপন নিয়মে মিটেও যায়। ফুটবল মাঠের নৈমিত্তিক ঘটনা। অথচ সেগুলোই এখানে ফুলিয়ে গাছ হয়ে যায়। কারণ মিডিয়া তো সারাক্ষণ হাজির। আমার হাতে ক্ষমতা থাকলে গোটা সপ্তাহে ওদের আমি এক দিন আধ ঘণ্টা প্র্যাক্টিস দেখতে দিতাম।
প্র: কলকাতা ময়দানের আপনাকে কী ভাবে স্মরণ করা উচিত বলে মনে হয়?
মর্গ্যান: আমাকে স্মরণ করে কী হবে? আমাকে ভুলে যাওয়াই ভাল।
প্র: তাও আপনার পরম্পরা কী, বলুন।
মর্গ্যান: আমার পরম্পরা সে-ই লোকটা, যে ক্লাবটাকে যেমন অবস্থায় পেয়েছিল তার চেয়ে অনেক উন্নত অবস্থায় নিয়ে গিয়েছে।
প্র: আপনার শেষ করাটা অনেকটা ফিল্মি এন্ডিং। নিশ্চয়ই কালকের ম্যাচের আগে বাড়তি চাপ ছিল। আমাদের কাগজে আপনার যেমন উচ্ছ্বাসের ছবি বেরিয়েছে, সচরাচর আপনাকে সে ভাবে দেখা যায় না।
মর্গ্যান: অনেক সময় হয় আবেগটা চেপে ধরে। আফটার অল মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ জেতা। স্কোরলাইন ৩-২। আসলে অন্তত তিন গোলের মার্জিনে আমাদের জেতা উচিত ছিল।
প্র: আসল স্কোরলাইন কিন্তু অন্য।
মর্গ্যান: সেটা আবার কী?
প্র: সেটা হল কলকাতা ময়দান-১ : ট্রেভর মর্গ্যান-০। ম্যাচ রিপোর্টে লেখা হবে, সিস্টেম বদলাতে গিয়ে লোকটা নিজেই ম্যাচ ছেড়ে চলে গিয়েছে।
মর্গ্যান: সেটা অন্য লোকেরা বিচার করুক। আমি নিজের মুখে কী বলব। আমি এটুকু বলব, ইস্টবেঙ্গল ক্লাব এক দিক দিয়ে ঠিক রাস্তায় হাঁটছে। যখন আমি এসেছিলাম তার তুলনায় স্টেডিয়ামের অনেক উন্নতি হয়েছে। মাঠ অনেক বেটার। জিম তো সুপার্ব। অনেক মেশিন আছে। আইস বাথ চাইলে পাওয়া যাবে। কিন্তু মাঠের বাইরের মনোভাবটা বদলানো দরকার। ভারতীয় ফুটবল অফিশিয়ালরা মনে করে, টিম করে দেব আমরা। এ বার টিমকে জেতাবে কোচ। এটা কোথাও হয় না। ইস্টবেঙ্গলে ফিফটি পার্সেন্ট টিম আমি বাছতে পেরেছি। বাকি ফিফটি পার্সেন্ট অফিশিয়ালদের। অহর্নিশি তুমি ভয় দেখাবে যে, রেজাল্ট দিতে না পারলে কোচ তুমি স্যাকড্। অথচ আমার পছন্দের দল বাছতে দেবে না, এটা কী ধরনের দ্বিচারিতা। সন্দীপ নন্দীকে না রাখার ব্যাপারে ওরা যে কাণ্ডটা করেছিল, আমি আজও ভুলতে পারিনি। অথচ সেই সন্দীপ এ বার চার্চিলের হয়ে কী খেলাটাই না খেলল। সেটা ভাবলেই আমি আরও হতাশ হয়ে পড়ি। আমি যে ধরনের ফুটবল-সভ্যতা থেকে এসেছি তাতে এ জিনিস কল্পনাই করা যায় না যে, কোচের অনুমতি ছাড়া অন্য কেউ দল বাছছে!
প্র: কলকাতা ছাড়ার এটা কি একটা বিশাল কারণ?
মর্গ্যান: এ বছর ততটা নয়, গত দু’বছর তো বটেই।
প্র: কর্তাদের সেন্টিমেন্ট হল আপনি আই লিগ দিতে পারলেন কোথায়?
মর্গ্যান: আমি আই লিগ সর্বস্বতায় বিশ্বাস করি না। আমি মনে করি না আই লিগ জিততে না পারলে পৃথিবীর সব স্বপ্ন ধ্বংস হয়ে গেল। গত তিন বছর আই লিগে আমরা যথেষ্ট ভাল করেছি। হয়তো জিতিনি। সমস্যা হল, জিতলে আবার বলা হত, সে কী কোচ, ফেডারেশন কাপ জিতলে না? ওটা জিতলেই তো ভারতসেরা দল হওয়া যায়। এএফসি কাপে গেলে না? তা হলে আর কী করলে? ইস্টবেঙ্গল হল পৃথিবীর সেই ক্লাব, যেখানে সব ট্রফি জেতা কম্পালসরি।
প্র: সুভাষ ভৌমিকের মধ্যে কী আছে বলে মনে হয়, যেটা তাঁকে আই লিগ জেতায়?
মর্গ্যান: বলতে পারব না। সুভাষের ট্রেনিং কখনও দেখিনি। ওকে কয়েক বার মিট করেছি। একই ভাবে ও-ও আমার ট্রেনিং কখনও দেখেনি। তবে অনেক সময় একটা নির্দিষ্ট গ্রুপ হাতে পেয়ে গেলে লাকটাও কাজ করে যায়।
প্র: এই আই লিগ চ্যাম্পিয়ন চার্চিল বনাম ইস্টবেঙ্গল পাঁচ ম্যাচ সিরিজ হলে কী রেজাল্ট হবে?
মর্গ্যান: এই মরসুমে আমরা এগিয়ে আছি ২-১। সিরিজটা খেলা হলে ফোর্থ ম্যাচটা জিতব। তখন আর শেষ ম্যাচের কোনও ভ্যালু থাকবে না।
প্র: আপনার সম্বন্ধে একটা ছোট সমালোচনা করিমের সঙ্গে আপনি কখনও হাত মেলান না। কালও মেলাননি।
মর্গ্যান: এটার উত্তর দিতে গেলে একটা অগ্নিগর্ভ ব্যাপার তৈরি হতে পারে। আমি ঢুকতে চাই না।
প্র: শোনা যায়, বড় ম্যাচের আগের রাত্তিরে করিম নাকি আপনার ফুটবলারদের ফোন করতেন। সেই থেকে আপনার এত রাগ।
মর্গ্যান: (চোয়াল শক্ত) এ ভাবে দেখা ভাল যে, কিছু লোকের সঙ্গে আপনি জীবনে হাঁটতে রাজি থাকবেন। কিছু লোকের সঙ্গে নয়।
প্র: উনি সত্যিই ফোন করতেন?
মর্গ্যান: প্লেয়ারদের জিজ্ঞেস করুন।
প্র: আপনাকে প্লেয়াররা কী বলেছে?
মর্গ্যান: বললাম তো, প্লেয়ারদের জিজ্ঞেস করুন।
প্র: আপনার প্রিয় শিষ্য টোলগে সম্পর্কে কাল ফেসবুকে পোস্ট হয়েছে ‘টুটু বসুর চেয়ে সামান্য জোরে দৌড়য়’।
মর্গ্যান: (হাসি) না, এতটা খারাপ নয়। তবে টোলগের এই সিজনটা খারাপ গেল। বেচারি ইনজিওর্ডও ছিল।
প্র: আপনার পরবর্তী ইস্টবেঙ্গল কোচ কে হতে পারে বলে মনে হয়?
মর্গ্যান: নো আইডিয়া। অ্যাবসোলিউটলি নো আইডিয়া।
প্র: এটা বিশ্বাস করতে বলেন যে, আপনি নিজে এখনও কোনও ক্লাব ঠিক করেননি?
মর্গ্যান: আমি সত্যিই কোনও ক্লাব ঠিক করিনি। আপাতত এখান থেকে চলে যাচ্ছি।
প্র: তা হলে ট্রেভর জেমস মর্গ্যানের আজ থেকে স্টেটাস কী? মধ্যবয়স্ক এক বেকার যুবক?
মর্গ্যান: হাঃ হাঃ হাঃ, ঠিক তাই। আর তাই কফির দামটা আপনি দেবেন! |