ড্রেসিংরুমের বারান্দায় বসা সচিন তেন্ডুলকরের হাসি যত চওড়া হচ্ছে, তত বেশি ঝুঁকে পড়ছে তাঁর কাঁধ।
শেন ওয়াটসনকে ছক্কা মেরে হরভজন সিংহ যখন ব্র্যাড হজের নকল করে নাচছেন, তখন তিনি বিধ্বস্ত অস্ট্রেলীয়কে বুকে জড়িয়ে ধরছেন।
যে ব্র্যাড হজ একটু আগে ক্যাচ ফস্কে হয়তো ম্যাচটাই মুম্বইকে উপহার দিয়ে এসেছেন, তিনি ড্রেসিংরুমে ঢুকছেন সেই ব্র্যাড হজেরই কাঁধে হাত রেখে!
তিনি রাহুল শরদ দ্রাবিড়। এ বারের আইপিএলে রূপকথার রূপক। প্রত্যাবর্তনের প্রতীক। যে দ্রাবিড়কে ব্যাটসম্যান হিসেবে যতটা দিয়েছে ইডেন, তার চেয়ে বেশি হয়তো কেড়ে নিয়েছে অধিনায়ক দ্রাবিড়ের থেকে। শুক্রবারের ইডেনেও তিনি রয়ে গেলেন সেই কর্ণের পার্শ্বচরিত্রেই। আর মাঠে না নেমেই অর্জুনের মুকুটটা নিয়ে গেলেন সচিন তেন্ডুলকর। |
রাহুল-রূপকথার দৌড় আজ থেমে যেতে পারে, কিন্তু বিজিত হয়েও আজ তিনি জয়ী। অন্তত ব্যক্তিগত মর্যাদার যুদ্ধে।
আইপিএল সিক্স শুরুর অনেক আগেই বলে দিয়েছিলেন, ক্রিকেটার হিসেবে এটাই তাঁর শেষ আইপিএল। ইডেনেও সম্ভবত শুক্রবার জীবনের শেষ ইনিংসটা খেলে গেলেন রাহুল দ্রাবিড়। সেই ইডেন, যেখানে ঐতিহাসিক ভাবে গ্যালারি সৌরভের দিকে থাকলেও বাইশ গজে বরাবর দাদাগিরি করে গিয়েছেন আরএসডি। কেকেআর ম্যাচে যেই ইডেনে অনেক নীচের দিকে ব্যাট করতে এসেছিলেন, সম্ভবত নাইটদের তৈরি করা পিচের বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদে। খেলেছিলেন সাকুল্যে তিনটে বল।
শুক্রবারের বৃষ্টিধোয়া ইডেনে যেন সেই আফসোস সুদে-আসলে মিটিয়ে নিলেন। ইডেনের স্লো ট্র্যাকে চল্লিশে পড়া ক্রিকেট-সাধকের টাইমিং বর্ণনা করার মতো বিশেষণ বোধহয় এখনও আবিষ্কার হয়নি। ক্রিকেট জীবনের সায়াহ্নে এসে, টিমের মহাকলঙ্কের ছায়া মাথায় নিয়ে দ্রাবিড়ের ব্যাটিং দেখলে মনে হবে জন্মসূত্রে তিনি কর্নাটকী হতে পারেন, কিন্তু ধমনীতে বোধহয় রাজপুত রক্তই বইছে। ৩৭ বলে তাঁর ৪৩ টি-টোয়েন্টির ‘জাম্পিং ঝপাক’ জগঝম্পের মধ্যে যেন হৃদয় মুচড়ে দেওয়া ধ্রুপদী সঙ্গীত। |
আর সেই ইনিংসের মঞ্চটা কী রকম? দ্রাবিড়দের হোমগ্রাউন্ডের পিচ যদি টেনিসের গ্রাসকোর্টের সঙ্গে তুলনীয় হয়, তা হলে ইডেনের বাইশ গজকে ক্লে কোর্ট বললে এতটুকু অত্যুক্তি হবে না। কেকেআরের নির্দেশ এ বার ছিল না, কিন্তু দিন কুড়ির মধ্যে পিচের চরিত্র আর কতটাই বা বদলানো সম্ভব? নিটফল ওয়াটসন ‘এলিমেন্টারি’ ডেলিভারিগুলো খেলতেও সমস্যায় পড়লেন। ঠিকঠাক ব্যাটটাই করতে পারলেন না। এত দিন বেশির ভাগ ম্যাচে দ্রাবিড়-রাহানে পার্টনারশিপটা টানছিল। শর্ট বলের সামনে রাহানের রোগ ধরতে পেরে মুম্বই সেই দাওয়াইটাই চালিয়ে গেল। মিচেল জনসনের একটা বল তো সোজা এসে লাগল তাঁর হেলমেটে।
ফাইনাল আর মুম্বইয়ের মধ্যে ‘ওয়াল’ হয়ে দাঁড়াতে পারতেন দ্রাবিড়ই। ২০০১ মুম্বই টেস্টে তাঁর ক্যাচ নিয়ে মাইকেল স্লেটারের স্লেজিং-কাণ্ডের পরে কোনও অস্ট্রেলীয় কিন্তু কর্নাটকীকে আর স্লেজ করেননি। ব্র্যাডম্যানের দেশে বরাবর তাঁর ভাবমূর্তিটা থেকে এসেছে ক্রিকেট আইকনের। স্লেটার নিজেই তো পরে বলেছিলেন, দ্রাবিড়কে স্লেজ করা তাঁর জীবনের অন্যতম বড় ভুল। কিন্তু স্লেটারের দর্শনকে তাঁরই স্বদেশীয় মিচেল জনসন গঙ্গাবক্ষে ছুড়ে ফেলে তৃতীয় ওভার থেকে দ্রাবিড়কে স্লেজ করা শুরু করলেন। উত্তরে পরপর দুটো বলে জনসনকে বাউন্ডারি মেরে দ্রাবিড়ও কিছু একটা পাল্টা বললেন। |
এত কিছুর পরেও কর্ণ সেই কর্ণই থেকে গেলেন। ব্যাটিং ব্যর্থতা ঢেকে তা-ও ১৬৫-এর কম্পিটিটিভ স্কোর তোলা গিয়েছিল। কিন্তু বোলিংয়ের ফাঁকফোকর কে ঢাকবে? এই পিচে যে দু’জন রাহুলের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সৈনিক হতে পারতেন, সেই অঙ্কিত চহ্বাণ আর অজিত চান্ডিলা তো দু’জনেই চরম বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি ভোগ করছেন! ডোয়েন স্মিথের ৪৪ বলে ৬২ রানের ইনিংসটা যখন শেষ হল, তখনই রাজস্থানের ডেথ ওয়ারেন্ট লেখা প্রায় শেষ। মুম্বইয়ের কাঠিন্য, নিষ্ঠা আর নির্মমতার সামনে দ্রাবিড়ীয় সভ্যতাও তখন অসহায়, বিপন্ন। যুক্তি ততক্ষণে হারিয়ে দিয়েছে আবেগকে। ম্যাচ শেষে ড্রেসিংরুমে ঢুকতে ঢুকতে টুপি খুলে গ্যালারিকে যখন স্যালুট করছেন দ্রাবিড়, ইডেনের প্রতিটা ঘাস যেন তখন ফিসফিস করছে, ‘হে বন্ধু, বিদায়!’
ঘরের টিম কবে ছিটকে গিয়েছে। দ্রাবিড়ও আজ থেকে নেই। সচিনের চোট আগামী আটচল্লিশ ঘণ্টায় সারবে কি না, প্রশ্ন আছে। ফাইনালের আগে আইপিএল থেকে তো রোম্যান্সটাই চলে গেল। পড়ে থাকল শুধু ক্রিকেট!
দলকে ফাইনালে তুলে হরভজনের নাচ। স্বস্তির হাসি সচিনদের। |
ছবি: শঙ্কর নাগ দাস ও উৎপল সরকার |