চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১...
মেলবন্ধন ঘটে ধ্রুপদী সৌন্দর্য ও প্রতিবাদী চেতনায়
সিমা গ্যালারিতে এখন চলছে গ্রীষ্মের প্রদর্শনী। প্রায় ৫০টি কাজ নিয়ে আয়োজিত এ বারের প্রদর্শনীতে ছবিরই প্রাধান্য। ভাস্কর্য রয়েছে মাত্র একটি। রবীন্দর রেড্ডির পলিস্টার রেজিন ও ফাইবার গ্লাসে করা একটি বৃহদাকার নারী মুখাবয়ব। ১৯৯৯-এর রচনা। উত্তর-আধুনিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে ঐতিহ্যকে আত্তীকৃত করার একটি দৃষ্টান্ত। ছবির ক্ষেত্রেও অবয়বী ছবির প্রাধান্য। পরিপূর্ণ বিমূর্ত রচনার সংখ্যা খুবই সীমিত। বিকল্প রূপকল্প বা অলটারনেটিভ আর্টের দৃষ্টান্ত রয়েছে মাত্র একটি। সঞ্জয় মণ্ডলের একটি ভিডিয়োগ্রাফি। শিরোনাম ‘অ্যাডিকটেড টু কেওস’। এর দু’টি অংশ। মোট দৈর্ঘ্য ২ মিনিট ৩৪ সেকেন্ড। দু’টি রচনাতেই পরিবৃত হিংসা ও সন্ত্রাসের কল্পরূপাত্মক প্রবহমান রূপকল্প গড়ে তুলেছেন শিল্পী। এর মধ্যে একটি রচনা খুবই কল্পনাদীপ্ত। অভিনব এক দৃষ্টিকোণ উন্মীলিত হয়েছে। পর্দায় ভেসে ওঠে একটি পিস্তল। অজস্র পোকার দ্বারা আক্রান্ত হয় সেটি। পিস্তলটি ভেঙে যেতে থাকে বা দ্রবীভূত হতে থাকে। ক্রমে ক্রমে ভূমিতে লীন হয়ে যায়। ভূমিতলে তখন পতঙ্গের আধিপত্য। এক দিকে জীবনজোড়া হিংসার আধিপত্য। অন্য দিকে জীবনেরও প্রবণতা থাকে হিংসাকে নির্মূল করার। এই দ্বৈতের সংঘাতে রচনাটি বিশেষ ভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
প্রদর্শনীর একটি ছবি
উল্লিখিত দু’টি রচনায় প্রকাশের দু’টি প্রান্ত আভাসিত হয়। একটি প্রতিবাদী। অন্যটি সমন্বিত সৌন্দর্যের সন্ধান। প্রদর্শনীর বাকি যে ছবি, সেগুলিও মোটামুটি এই দু’টি প্রবণতায় বিভক্ত। এটা আমাদের চিত্রকলার আধুনিকতার একটা বৈশিষ্ট্য। ধ্রুপদী সৌন্দর্য ও প্রতিবাদী-চেতনার মধ্যে আন্দোলিত হওয়া। নব্য-ভারতীয় ঘরানার শিল্পীরা সমন্বিত সৌন্দর্যের সাধনাতেই মগ্ন ছিলেন বেশি। অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল থেকে যামিনী রায়, বিনোদবিহারী পর্যন্ত এই সদর্থক সৌন্দর্যের নানা দিক উন্মীলিত হয়েছে। অবনীন্দ্রনাথ অবশ্য একটা পর্যায়ে কৌতুকদীপ্ত সূক্ষ্ম এক প্রতিবাদী চেতনার দিকে গেছেন। তাঁর ‘খুদ্দুর যাত্রা’ এর অনবদ্য দৃষ্টান্ত। গগনেন্দ্রনাথের কার্টুনধর্মী রচনায় যে সমাজবাস্তবতার বিশ্লেষণ দেখা দেয়, সেটাই ১৯৪০-এর দশকের আধুনিকতাবাদী চিত্রধারায় আরও ঘনীভূত হয়ে পরিবৃত অন্ধকারকে প্রতীকায়িত করতে থাকে।
এই প্রদর্শনীতে যে সব শিল্পী নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁরা প্রায় সকলেই ১৯৬০-এর দশক থেকে একবিংশ শতকের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করেছেন। রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দুপুর’ ছবিটিতে কয়েক জন নারীর সুস্মিত উপস্থাপনা নব্য-ভারতীয় ধারার আবহকে বুঝতে সাহায্য করে। এই আলোকিত অভিমুখই কেমন করে তমসাকে তুলে আনে তার অনবদ্য দৃষ্টান্ত গণেশ পাইনের ছবিটি। মহাভারত চিত্রমালার অন্তর্গত ‘ভীমসেন ও ঘটোৎকচ’ ছবিটিতে পুরাণকল্পবিধৃত যে মৃত্যু আভাসিত হয়, তার অন্তর্গত তমসা অর্পিতা সিংহের ১৯৮১-তে করা জলরঙের নিসর্গটিতে এই দুই দৃষ্টিকোণের এক দ্বান্দ্বিক সহাবস্থান আমরা লক্ষ করি। যোগেন চৌধুরীর ১৯৮২-র সেরিগ্রাফটিও অনেকটা সমধর্মী। এই আশা-নিরাশার দ্বন্দ্ব অনুভব করা যায় সুধীর পটবর্ধনের ১৯৯৮-র ‘পেরেন্ট উইথ চাইল্ড’ ছবিটিতেও।
পরেশ মাইতির ‘ক্লোজনেস’ ছবি দু’টিতে লৌকিকের সারল্য ঋজু কৌণিক জ্যামিতিতে অভিষিক্ত হয়। এক আলো-আঁধারি রহস্যময়তা তৈরি করে তা। জয়শ্রী বর্মনের ‘জলকন্যা’ রূপকথার জগৎকে উন্মীলিত করে। অনুপ এম জি-র ‘রুরাল/ আরবান গ্যালারি’, সজল কাইতির প্রজাপতি ও মৌমাছি নিয়ে করা জলরঙের রচনা ঐতিহ্যদীপ্ত সদর্থকতার দৃষ্টান্ত।
তা সত্ত্বেও ভাঙা বিশ্বের বিপন্নতাই যে হয়ে ওঠে সাম্প্রতিক ছবির প্রধান প্রকাশভঙ্গি এই প্রদর্শনীর অনেক ছবিতেই তার নিদর্শন ধরা থাকে। দেবাশিস চক্রবর্তীর ‘স্টুপিড কমন ম্যান’ ছবিতে মানুষের মুখের অভিব্যক্তিবাদী তীব্র বিকৃতি সেই বিপন্নতারই স্মারক। বেহুলেয়ান সি.বি.-র রেলওয়ে ইয়ার্ডের ছবিটিতে বাস্তবতার প্রগাঢ় রূপ ধরা পড়ে। বারা ভাস্করনের ‘কলোনিয়াল কিংডম’, পি এস জালাজা-র ‘আদার ফিশ টু ফ্রাই’, সৌগত দাসের ‘ফ্যানাটিক’, সলিল সাহানির দু’টি ছাপচিত্র আঙ্গিকের অভিনবত্বে সমাজবাস্তবতার নানা দিককে প্রতীকায়িত করে। সুমিত্র বসাকের তিনটি ছবিতে এই বাস্তবতা বিশ্লেষিত হয় পপ-আর্ট অনুসারী শ্লেষাত্মক কৌতুকের ভিতর দিয়ে। রমেশ টেকাম-এর উপজাতীয় আঙ্গিকের ছবি এই প্রদর্শনীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য। জীবন ও প্রকৃতির সামগ্রিক একাত্মতার প্রজ্ঞা নাগরিক সংস্কৃতিকে অনেক সমৃদ্ধ করে তুলতে পারে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.