তাঁরা অভিযোগ করেছিলেন, “এই মেয়ে আমাদের নয়। সন্তান বদল হয়েছে। ছেলের বদলে সরকারি হাসপাতাল হাতে দিয়েছে মেয়ে।” চার মাস পরে শুক্রবার কেন্দ্রীয় ফরেন্সিক ল্যাবরেটরিতে তাঁদের ডিএনএ পরীক্ষার রিপোর্ট আসতে জানা গেল মেয়ে তাঁদেরই। সে ক্ষেত্রে ছেলে হওয়ার দাবির আর কোনও জোর থাকে না।
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের ঘটনা। গত ১৬ জানুয়ারি রাতে রাজারহাটের নারায়ণপুর অঞ্চলের বাসিন্দা, সরবরি বেগম নামে এক মহিলা আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সন্তান প্রসব করেন। পরের দিন তাঁর স্বামী আব্দুল সাদিক অভিযোগ করেন, সরবরি পুত্রসন্তান প্রসব করেছিলেন। কিন্তু তাঁর সন্তান বদলে কন্যাসন্তান করে দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে নেমে পুলিশ দেখে, হাসপাতালের রেজিস্টারে পুত্রসন্তান করা হয়েছিল। পরে তা কেটে কন্যাসন্তান করা হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি ছিল, “কর্তব্যরত নার্স এবং চিকিৎসকেরা ভুল করে রেজিস্টারে কন্যার জায়গায় পুত্র লিখে ফেলেছিলেন। পরে ভুল বুঝে কেটে ঠিক করা হয়েছে।
তখনকার মতো শিশুটিকে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ওই দম্পতির অভিযোগের ভিত্তিতে আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী, ডিএনএ পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। কলকাতা পুলিশের এক কর্তা জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে ওই শিশু ও তাঁর বাবা-মায়ের রক্তের নমুনা পাঠানো হয়েছিল। তা মিলে গিয়েছে বলে এ দিন রিপোর্ট পাওয়া গিয়েছে।
এখান থেকেই উঠতে শুরু করেছে একাধিক প্রশ্ন। মাথাচাড়া দিতে শুরু করেছে জল্পনা। তা হলে কি জন্মের পরেই নিজের শিশুকন্যাকে অস্বীকার করার মধ্যে ঘাপটি মেরে রয়েছে পুত্রসন্তানের কামনা? ওই দম্পতির এর আগে একটি বছর এগারোর ছেলে এবং বছর ছয়েকের মেয়ে রয়েছে। সেই অর্থে ছেলের মরিয়া ইচ্ছা তাঁদের হওয়ার কথা নয়। সরবরিদেবীকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, হাসপাতাল যদি আপনার কোলে মেয়ের জায়গায় একটি ছেলেকে ভুল করেও দিতেন, তা হলে কি একই ভাবে তাকে নিজের নয় বলে প্রতাখ্যান করতেন?
চুপ করে ছিলেন সরবরিদেবী। অনেকক্ষণ পরে নিচু স্বরে শুধু বলেছেন, “লড়কি মেরি নহি হ্যায়।”
অর্থাৎ, এখনও অস্বীকার!
সব শুনে উদ্বিগ্ন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবী-বিদ্যা (উইমেন্স স্টাডিজ) বিভাগের অধ্যাপিকা পারমিতা চক্রবর্তী। তিনি বলেন, “আমার তো মনে হচ্ছে এটা কন্যাসন্তানের উপরে হিংসার আরও একটা ভয়াবহ রূপ। মেয়ে হলে মনখারাপ, কান্নাকাটি আমাদের দেশে এখনও স্বাভাবিক ছবি। তবে তার মধ্যে ভবিতব্যকে স্বীকার করে নিয়ে আক্ষেপ করা থাকে। আর যাঁরা স্বীকারই করতে পারেন না, তাঁরা ভ্রূণহত্যা, মেয়ে জন্মানোর পর মেরে ফেলার পথে যান। এরই একটা নতুন রূপ হল নিজের মেয়েকে এই ভাবে অস্বীকার করা এবং শিশু বদলের অভিযোগ তোলা।”
একই বক্তব্য নারী-আন্দোলনের কর্মী শাশ্বতী ঘোষেরও। তিনি বলেন, “আমাদের দেশে ভ্রূণহত্যার পাশাপাশি সদ্যোজাতকে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়, বালিশ চাপা গিয়ে মারা হয়, মেলায় গিয়ে ছেড়ে আসা হয়। এ বার এটা বোধহয় নতুন একটা পন্থা শুরু হল।” আফশোস করছিলেন সমাজতাত্ত্বিক অভিজিৎ মিত্রও। “ছেলে মানেই সমাজে এক জনের দাপট বেড়ে যাওয়া আর মেয়ে মানেই অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতা এই সামাজিক ধারণার পরিবর্তন আর কবে হবে?” ‘ইউনাইটেড নেশনস ডিপার্টমেন্ট অফ ইকনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল অ্যাফেয়ার্স’-এর সাম্প্রতিক রিপোর্ট জানিয়েছে, পৃথিবীর ১৫টি রাষ্ট্রের মধ্যে এক থেকে পাঁচ বছর বয়সী মেয়েদের জন্য সব চেয়ে ভয়ঙ্কর দেশ ভারত। কারণ, মেয়েরা এখানে ‘ভ্যানিশ’ হয়ে যায়।
আরজিকর-এর ঘটনা কি সেই ‘ভ্যানিশ’ করার প্রক্রিয়ার একটা দিক উন্মুক্ত করল? সেটাই এখন ভাবছেন মানবীচর্চা (উইমেন্স স্টাডিজ) ও নারী-আন্দোলনে জড়িতেরা। |