আঁকা শিখতে কেরল থেকে শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন বছর আঠারোর ছেলেটি। কিন্তু কোনও চিত্রকর নয়, এক ভাস্করের মধ্যে তিনি আবিষ্কার করলেন তাঁর গুরুকে।
সারা বিশ্বে পরিচিত হয়ে যাওয়ার পরেও ‘মাইয়া অন মসুই’ ভাস্কর্যের স্রষ্টা কে এস রাধাকৃষ্ণণ এখনও সেই দিনগুলি ভুলতে পারেন না। সে দিন তিনি ঠিক করে ফেলেছেন, রামকিঙ্কর বেইজের কাছে ভাস্কর্য শিখবেন। কিন্তু গুরুর কাছে মনের কথা বলবেন কী করে? বাংলাটাই যে তাঁর সড়গড় নয়!
|
“আমায় সে দিন সাহায্য করেন কলাভবনের শর্বরীদা”— ঘনিয়ে আসা বিকেলে কাঁচাপাকা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলেন মাঝবয়সী ভাস্কর। ‘শর্বরীদা’ বলতে প্রখ্যাত ভাস্কর তথা অধ্যাপক শর্বরী রায়চৌধুরী। তিনিই কেরলের তরুণটিকে বলেন, ‘তুমি রামকিঙ্করের কাছে যাও। কথা বলার দরকার নেই। তোমায় দেখলেই উনি তোমার মনের চাহিদা বুঝে যাবেন।’
রাধাকৃষ্ণণ আর দেরি করেননি। দ্রুত বাংলা শিখতে শুরু করেছিলেন। তাঁর কথায়, “তাড়াতাড়ি বাংলা শিখে কিঙ্করদার ঘনিষ্ঠ হতে পেরেছিলাম। ১৯৭৪ সালে কলাভবনে ভর্তি হয়েছিলাম। ১৯৭৬ থেকেই ভাস্কর্য গড়তে শুরু করি।” তাঁর মনে পড়ে, “আমি কলাভবনের স্টুডিওয় কাজ করার সময়ে খবর পেলে শুধু আমার জন্যই কিঙ্করদা চলে আসতেন। তাঁর সুপারিশেই আমি তিন বছর পরে ন্যাশনাল স্কলারশিপ পাই।” |
গুরুর সেই শিক্ষা এখন তাঁকে আন্তর্জাতিক পরিচিতি দিয়েছে। তিনিও গুরুর ঋণ ভোলেননি। ২০০৬ সালে রামকিঙ্করের জন্মশতবর্ষে সংস্কৃতি মন্ত্রকের অনুরোধে তিনি গুরুর ছবি ও তথ্য সংবলিত গ্রন্থ প্রকাশের দায়িত্ব নেন। “কিঙ্করদা কাউকে ছবি উপহার দিয়েছেন বা কেউ কিনেছেন, কিঙ্করদা সম্পর্কে কোথাও লেখা বেরিয়েছে খবর পেলেই ছুটেছি।” গত বছরই প্রকাশ পেয়েছে ৪৫০ পৃষ্ঠার সেই বই। দিল্লি, মুম্বই ও বেঙ্গালুরুতে রামকিঙ্করের সৃষ্টির প্রদর্শনীও করেছেন তিনি।
এখন দিল্লিতে থাকলেও সম্প্রতি শান্তিনিকেতনে পূর্বপল্লিতে স্টুডিও গড়ে রাধাকৃষ্ণণ শুরু করেছেন ‘মাইয়া অন মসুই’-এর নতুন নির্মাণ। কিন্তু বিশ্বভারতীরই কিছু লোক যে তাঁর গুরুকে ভাল চোখে দেখতেন না? গম্ভীর হয়ে ওঠে রাধাকৃষ্ণণের গলা, “ওরা কারা? কিছু তথাকথিত বাবু-কালচারের লোক! রামকিঙ্কর ওসবের পরোয়া করতেন না।” তার পরেই বলে ওঠেন, “কিছু মেধাবী পড়ুয়া বা অধ্যাপকের জন্য নয়। রবীন্দ্রনাথের পরে রামকিঙ্কর বেইজ, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, নন্দলাল বসুদের জন্যই বিশ্বভারতী বিশ্বে পরিচিতি পেয়েছে।”
|
ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়। |