সারদা-র মতো কোনও অর্থলগ্নি সংস্থায় টাকা রাখেননি তিনি। এলাকার ডাকঘরের কর্মীর হাতে টাকা জমা দিয়ে, সেভিংস বইতে লিখিয়ে নিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন। একটু একটু করে জমেছিল দু’লক্ষের বেশি টাকা। মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা তুলতে গিয়ে জানতে পারলেন, টাকা জমাই পড়েনি
ডাক-কর্তৃপক্ষের কাছে।
বর্ধমানের ভাতারের বাসিন্দা শেখ আজহার আলির সঙ্গে এমনটাই ঘটেছে বলে অভিযোগ। বেসরকারি একটি নিরাপত্তা-সংস্থার রক্ষী আজহার আলি ২০১১ সালে গুসকরা ডাকঘরের অধীন দাউড়াডাঙা উপ-ডাকঘরে একটি সেভিংস অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন। ওই ডাকঘরের দায়িত্বে ছিলেন গ্রামীণ ডাক-সেবক মৃত্যুঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। আজাহারের অভিযোগ, “আগে আমি ওই গ্রামে থাকতাম। মৃত্যুঞ্জয়বাবুকে নিয়মিত টাকা দিতাম। মেয়ের বিয়ের জন্য ফেব্রুয়ারি মাসে ডাকঘরে গিয়ে জানতে পারি, টাকা জমাই পড়েনি।”
মৃত্যুঞ্জয়বাবু কোথায়? খোঁজ নিতে গিয়ে আজহার জানলেন, মৃত্যুঞ্জয় জানুয়ারি মাসে আত্মহত্যা করেছেন।
এখন উপায়? জানা গিয়েছে, শুধু আজহার নন, একই হাল হয়েছে গ্রামবাসীদের অনেকেরই। স্থানীয় মাঝেরপাড়ার বাসিন্দা সমীরণ মুখোপাধ্যায়, শিশির মণ্ডল ও রমানাথ ঘোষরা জানান, মৃত্যুঞ্জয়বাবু প্রচুর জাল পাসবই তৈরি করেছিলেন। রেকারিং বা ফিক্সড ডিপোজিট স্কিমে টাকা জমা করে তিনি পাসবই-এ লিখে স্ট্যাম্প মেরে দিতেন। সমীরণবাবু বলেন, “আমরা ভেবেছিলাম, টাকা ঠিক মতো ডাক বিভাগেই জমা পড়ছে।” গত ২৯ জানুয়ারি মৃত্যুঞ্জয়বাবু কীটনাশক খান। পরদিন হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর অবর্তমানে গ্রাহকেরা তাঁদের সেভিংস বই নিয়ে গুসকরা ডাকঘরে যোগাযোগ করেন। তখনই বিষয়টি সামনে আসে। |
এক দিকে অর্থ লগ্নি সংস্থার ফাঁদে পা দিয়ে সর্বস্ব খুইয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। ডাকবিভাগে টাকা রাখতে গিয়েও যে প্রতারণার হাত থেকে নিস্তার নেই, সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল গুসকরার ঘটনা। সাধারণ মানুষ তবে কোথায় ভরসা করবেন, প্রশ্ন তুলছেন গ্রামবাসীরা।
প্রাথমিক তদন্তে ডাক কর্তৃপক্ষ জেনেছেন, সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ডাককর্মী মৃত্যুঞ্জয় ওই টাকা অন্য কোনও জায়গায় খাটাতেন। গ্রামবাসীদের অভিযোগ, মৃত্যুঞ্জয়বাবু বেকার যুবকদের বিভিন্ন সরকারি দফতরে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতেন। এর জন্য তাঁকে কোনও টাকা দিতে হবে না বলেও তিনি সবাইকে বলতেন। শুধু শর্ত ছিল, ওই সব যুবক যেন ডাক বিভাগের বিভিন্ন প্রকল্পে টাকা জমা রাখেন। চাকরি পাওয়ার আশায় ওই যুবকরা পরিবারের লোকেদের বুঝিয়ে মৃত্যুঞ্জয়বাবুর কাছে টাকা জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু মৃত্যুঞ্জয়বাবু সেই টাকা আর ডাক বিভাগে জমা দেননি বলে গ্রামবাসীদের অভিযোগ।
গুসকরার ডাক বিভাগের এক অফিসার জানিয়েছেন মালডাঙা, পানাগড়, ইলমবাজার, ভেদিয়া, মহাতা, রায়রামচন্দ্রপুরের মতো বিভিন্ন এলাকা থেকে অন্তত ২০টি অভিযোগ তাঁদের হাতে এসেছে। সব মিলিয়ে প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা তছরুপ হয়েছে বলে তাঁদের আশঙ্কা। ডাক বিভাগের বর্ধমান ডিভিশনের সিনিয়র সুপারিন্টেনডেন্ট এন প্রকাশ বলেছেন, “গুসকরার ইনস্পেক্টর অফ পোস্ট অফিসকে বলা হয়েছে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিতে। এই রিপোর্টের ভিত্তিতে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়া যায় কি না তা খতিয়ে দেখব।”
ডাক বিভাগ সূত্রের খবর, ২০০৫-০৬ সাল থেকে ২০১৩-র গোড়া পর্যন্ত এই ভাবে টাকা তছরুপ হয়েছে বলে প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছে। কিন্তু এত দিন ধরে ডাক বিভাগের নাম করে টাকা তুলে, তা সঠিক জায়গায় জমা না দেওয়ার দায় কি এড়াতে পারেন ডাক-কর্তৃপক্ষ? ডাক বিভাগের এক অফিসার জানান, নিয়ম অনুযায়ী কয়েক মাস অন্তর প্রতিটি পাসবই বা সঞ্চয় সংক্রান্ত কাগজপত্র খতিয়ে দেখার কথা অফিসারদের। এ ক্ষেত্রে তা করা হয়নি বলেই মনে হচ্ছে। তবে এই গাফিলতির সঙ্গে অন্য কোনও অফিসার যুক্ত আছেন কি না, তা বুঝতে গুসকরা ডাকঘরের গত চার বছরের ইনস্পেকশন রিপোর্ট বাজেয়াপ্ত করেছেন ডাক-কর্তৃপক্ষ।
কিন্তু আমানতকারীরা কি তাঁদের টাকা ফেরত পাবেন?
চিফ পোস্ট মাস্টার জেনারেল (সিপিএমজি-বেঙ্গল সার্কল) যশোবন্ত সিংহ বলেন, “কারও নামে যদি টাকা ডাকঘরে জমা না পড়ে, তবে কী করে তাঁকে ওই টাকা ফেরত দেওয়া যাবে?” কিন্তু গ্রামবাসীরা কেন ডাকঘরের মতো জায়গায় জমা দিয়েও তাঁদের টাকা ফেরত পাবেন না? সিপিএমজি বলেন, “ডাককর্মী মারফৎ কেউ টাকা জমা দিলেও, কিছু দিন অন্তর গ্রাহককে নিজেই ডাকঘরে এসে ওই টাকা জমা পড়ছে কি না, তা খতিয়ে দেখে নিতে হবে। আগেও গ্রাহকদের আমরা এই অনুরোধ করেছি। আবারও করছি।” স্থানীয় বাসিন্দা হিসেবে মৃত্যুঞ্জয়বাবুকে চোখ বুজে বিশ্বাস করেই ঠকেছেন গ্রামবাসীরা। গুসকরার পোস্টমাস্টার তপনকুমার সেন বলেন, “গ্রামীণ ডাক-সেবক হিসাবে দীর্ঘদিন কাজ করছেন মৃত্যুঞ্জয়বাবু। তাঁর নিজের দোতলা বাড়ি রয়েছে। শোনা যাচ্ছে, কয়েক বছরে তিনি প্রায় ৬৫ বিঘা জমিও কিনেছিলেন।” অভিযুক্ত ডাককর্মীর ওই সম্পত্তি অধিগ্রহণ করে আমানতকারীর টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য আদালতে মামলা করতে হবে বলে মনে করছেন ডাক-কর্তৃপক্ষ। তবে অভিযুক্ত মারা গিয়েছেন বলে বিষয়টি যথেষ্টই জটিল হয়ে পড়েছে। মৃত্যুঞ্জয়বাবুর স্ত্রী জানিয়েছেন, তাঁর ছেলে কলেজে পড়ে। পাওনাদাররা রোজ তাগাদা করতে আসছেন।
এত কিছুর পরে ডাকঘরে টাকা রেখে তা হলে সাধারণ মানুষ নিশ্চিন্ত হবেন কী করে? সিপিএমজি বলেন, “স্বচ্ছতা আনার চেষ্টায় আমরা গ্রামীণ ডাকঘরগুলোতেও কম্পিউটার বসানোর চেষ্টা করছি। কোর-নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অন্য ডাকঘর থেকেও গ্রাহকরা যাতে তাঁর আমানতের হিসেব দেখতে পান, তার ব্যবস্থাও করা হচ্ছে।”
|