ডাকঘরে টাকা রাখছেন?
প্রথমেই ঠিক করে রাখুন, আপনার অবর্তমানে সেই টাকা পাবে কে। নথিপত্রে তাঁর নাম-ধাম নিয়ে যেন কোনও জটিলতা না থাকে। বাসস্থান বদলালে নতুন ঠিকানা লিখিয়ে রাখতে যেন ভুল না হয়। আর অ্যাকাউন্ট খোলার সময়ে ডাকঘরের খাতায় কী ভাবে সই করলেন, সেটাও মনে রাখুন। কারণ, মেয়াদশেষে টাকা হাতে পেতে হলে ওই সইটাই নিখুঁত ভাবে করা চাই।
বস্তুতই, কাগজপত্র সব নিখুঁত না-থাকলে আমানতের অর্থ পেতে বিস্তর ঝামেলা। ডাক-কর্তৃপক্ষের দাবি, বহু গ্রাহক এটা খেয়াল রাখেন না বলেই ডাকঘরে জমা দাবিহীন টাকার পরিমাণ ক্রমে বেড়ে চলেছে। গোটা দেশে এই তালিকার শীর্ষে পশ্চিমবঙ্গ। লোকসভায় টেলি-যোগাযোগমন্ত্রী কপিল সিব্বলের লিখিত উত্তরে সম্প্রতি জানা গিয়েছে, এ রাজ্যের বিভিন্ন ডাকঘরের বিভিন্ন আমানতে পড়ে থাকা ‘বেওয়ারিশ’ টাকার অঙ্ক প্রায় ১০৭ কোটি!
ডাকঘরে সেভিংস, রেকারিং ইত্যাদি অ্যকাউন্ট ছাড়াও টার্ম ডিপজিট (মেয়াদি আমানত), মাসিক সঞ্চয় প্রকল্প (এমআইএস) বা পাবলিক প্রভিডেন্ট ফান্ড (পিপিএফ)-এর মতো সঞ্চয়ের বিবিধ ব্যবস্থা রয়েছে। অধিকাংশ অ্যাকাউন্টে তিন বছর টাকা দেওয়া-নেওয়া না-হলে তা অকেজো হয়ে যায়। সেগুলোকে বলে ‘সাইলেন্ট অ্যাকাউন্ট।’ সংশ্লিষ্ট গ্রাহক বা তাঁর উত্তরাধিকারী উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণ দিয়ে সেটি পরে চালু করতে পারেন, টাকাও তুলে নিতে পারেন।
তা হলে সমস্যা কোথায়? এ জন্য ডাক-কর্তৃপক্ষ দায়ী করছেন আমানতকারীদের একাংশের ‘সচেতনতার অভাব’কে। যেমন? কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যা: হঠাৎ হয়তো আমানতকারী মারা গেলেন। দেখা গেল, তাঁর অ্যাকাউন্টের উত্তরাধিকারী (নমিনি) কে, সে সম্পর্কে প্রয়োজনীয় নথি তিনি ডাকঘরে জমা দেননি। কিছু ক্ষেত্রে ‘প্রকৃত’ উত্তরাধিকারী কে, তা নিয়েও জটিলতা থাকে। এতে অ্যকাউন্টটি দাবিহীন হয়ে পড়ে। আবার অ্যাকাউন্ট সংক্রান্ত কাগজপত্র হারিয়ে গেলেও কিছু লোক নিয়ম মেনে সময় মতো তার প্রতিলিপি জোগাড় করে রাখায় গা করেন না। ফল তাঁকেই ভুগতে হয়, মেয়াদ শেষে টাকা তুলতে গিয়ে তিনি বিপদে পড়েন। এ ভাবেও বহু আমানতের উপরে অনেকে দাবি হারাচ্ছেন। পাশাপাশি অ্যাকাউন্টে জমা টাকার পরিমাণ বেশি না-হলে অনেক গ্রাহক কর্মসূত্রে বদলি হয়ে যাওয়ার পরে সেটির কথা কার্যত ভুলে যান। সেই টাকা ‘সাইলেন্ট অ্যাকাউন্টে’ চলে যায়। |
কেন দাবিহীন |
• মৃত গ্রাহকের উত্তরাধিকারীর নাম নেই
• হারানো নথির প্রতিলিপি নেননি গ্রাহক
• দীর্ঘ সময় অ্যাকাউন্টে লেনদেন নেই
• প্রথম সইয়ের আদল ভুলেছেন গ্রাহক |
|
‘সাইলেন্ট অ্যাকাউন্ট’-এর টাকা পাওয়ার পদ্ধতি কী? ডাক-সূত্রের খবর: সাইলেন্ট অ্যাকাউন্টে জমা ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত পাওয়ার দাবি সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক ডাক-অধিকর্তা মেটাতে পারেন। দাবির অঙ্ক এর বেশি হলে পোস্টমাস্টার জেনারেলের অনুমোদন দরকার। আর দাবি ৫০ হাজার বা তার বেশি হলে ‘ইনডেমনিটি বন্ড’ প্রয়োজন। গ্রাহকদের অনেকের অবশ্য অভিযোগ, সাইলেন্ট অ্যাকাউন্টের টাকা উদ্ধার করতে গিয়ে ডাকঘর-কর্মীদের একাংশের ‘অসহযোগিতা’র মুখে পড়তে হচ্ছে। ডাক-কর্তারা কী বলেন? ‘বেঙ্গল সার্কল’-এর চিফ পোস্টমাস্টার জেনারেল (সিপিএমজি) হুমেরা আহমেদ কোনও মন্তব্য করতে চাননি। যোগাযোগ মন্ত্রকের এক পদস্থ অফিসার অবশ্য বলেন, “সাইলেন্ট অ্যাকাউন্টের টাকা আবেদনকারীকে দেওয়ার আগে ডাক-কর্মীরা নিশ্চিত হতে চান, যাতে ভবিষ্যতে আইনি কোনও জটিলতায় পড়তে না হয়।” ডাক-সূত্রের দাবি, কিছু ক্ষেত্রে প্রয়াত গ্রাহকের একাধিক বিবাহ কিংবা পারিবারিক সদস্যদের সহমতের অভাবের দরুণ ডাকঘরে জমা টাকা আবেদনকারীকে দেওয়া যাচ্ছে না। আবার ডাক-কর্মী সংগঠনগুলির পাল্টা অভিযোগ, ওই সব জটিলতা মেটাতে আমানতকারীর তরফে যতটা সহযোগিতা থাকা দরকার, অনেক ক্ষেত্রে তাতে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।
এ সবেরই মিলিত প্রতিক্রিয়ায় ডাক-আমানতে বিপুল দাবিহীন অর্থের সঞ্চয়। পশ্চিমবঙ্গ, সিকিম ও আন্দামান নিয়ে ডাক বিভাগের ‘বেঙ্গল সার্কল।’ দাবিহীন অর্থের তালিকায় এই ‘বেঙ্গল সার্কল’ শীর্ষে, নাকি পশ্চিমবঙ্গ সে ব্যাপারে এ রাজ্যের ডাক-কর্তারা এখনও নিশ্চিত নন। যদিও বেঙ্গল সার্কলে যা লেনদেন, তার ৮০ শতাংশই পশ্চিমবঙ্গের।
তবে শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়। দেশের প্রায় সব রাজ্যেই দাবিহীন ডাক-সঞ্চয়ের অঙ্ক ঊর্ধ্বগামী। লোকসভায় পেশ করা কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর তথ্য (২০১১-র ৩১ মার্চ পর্যন্ত) অনুযায়ী, তালিকায় দ্বিতীয় নাম তামিলনাড়ুর। সেখানে ৬২ লক্ষ ৭২ হাজার অ্যাকাউন্টে ১০৫ কোটি ৮৭ লক্ষ টাকা ‘বেওয়ারিশ’ পড়ে আছে। তার পরে উত্তরপ্রদেশ ২১ লক্ষ ৭৪ হাজার অ্যাকাউন্টে ৬৮ কোটি ৬১ লক্ষ টাকা। গোটা দেশে দাবিহীন ডাক-আমানত প্রায় আড়াই লক্ষ। জমা সাড়ে সাতশো কোটির উপর। |