কলকাতা সফরে এসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মার্কিন বিদেশসচিব হিলারি ক্লিন্টন জানিয়ে গিয়েছিলেন, লগ্নির ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গকে ‘অংশীদার রাজ্য’ হিসেবে তাঁরা পেতে আগ্রহী। এ বার এই শহরে আসা এক মার্কিন বিদেশনীতি বিশেষজ্ঞ বললেন, “ইতিহাসের এক অপূর্ব সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গ। বাংলার মানুষকে, এখানকার রাজনীতিকদের নতুন করে ভাবা উচিত। তা হলেই এক সম্ভাব্য অর্থনৈতিক পালাবদলের অংশীদার হতে পারবে পশ্চিমবঙ্গ।”
 |
রাসেল মিড |
সম্প্রতি কলকাতা এসেছিলেন মার্কিন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ওয়াল্টার রাসেল মিড। তাঁর কথায়, “এই একবিংশ শতকে বিশ্ববাজার থাকবে এশিয়ার নিয়ন্ত্রণে। আর সেই উত্থানের এক সার্থক অংশীদার ভারত হয়ে উঠতে পারবে যদি তারা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ও জাপানের মতো দেশগুলি থেকে আসা সুযোগের সদ্ব্যবহার করে।” শুধু তা-ই নয়, মিডের আশা, ভারতীয় অর্থনীতির এই পালাবদলে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে পশ্চিমবঙ্গ।
কী ভাবে এই পালাবদলে সামিল হতে পারে বাংলা?
বুঝিয়ে দিলেন মিড। “একটা কথা কলকাতা সম্পর্কে প্রায়ই শুনি। এই শহরটা দেশের এক প্রান্তে। এই এলাকার বাসিন্দারাও যেন ‘প্রান্তবাসী’। কিন্তু আমি ব্যাপারটা অন্য ভাবে দেখি।” সেই ‘অন্য রকমটা’ কেমন? “দেখুন, সম্প্রতি মায়ানমারের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে তারা যোগ দিতে আগ্রহী। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ‘প্রবেশ পথ’ কলকাতা। এই সব সুযোগের যদি সদ্ব্যবহার করা হয়, পশ্চিমবঙ্গ প্রচুর লাভবান হবে। ব্রিটিশ আমলের কথা ভাবুন, যখন কলকাতা ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ছিল। তখন কিন্তু ‘ভারত’ বলতে বাংলাদেশ, মায়ানমার, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আরও বেশ কিছুটা অংশ। আমরা যদি সে-ভাবে ভাবি, ‘ভারতবর্ষ’-এর মধ্যে আবদ্ধ না-থেকে ‘দক্ষিণ এশিয়া’র এই অংশকে একটি ভৌগোলিক ক্ষেত্র বলে ধরে নিই, সেই অঞ্চলের কেন্দ্রে থাকবে কলকাতা। তখন আর কলকাতা ‘প্রান্তে’ নয়, ‘কেন্দ্রে’।
তবে দু’-একটা বিষয়ে যে নজর না-দিলেই নয়, তা-ও মেনে নিচ্ছেন অধ্যাপক মিড। নিত্যনতুন বিনিয়োগ টানা, বা ধরে রাখার জন্য এ দেশের, বা এই রাজ্যের যা যা করা প্রয়োজন, তা এখানে হচ্ছে কি? যেমন বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দরের উন্নতি, রাস্তার হাল ফেরানো, পর্যাপ্ত বিদ্যুতের ব্যবস্থা...। আর সব কিছুর উপরে দরকার তো শিল্পের জন্য জমি। “এই রাজ্যে এটা একটা খুব বড় সমস্যা,” মানেন তিনি। আর এ-ও জানেন, “এর সমাধান কিন্তু এ রাজ্যকেই খুঁজে বার করতে হবে। এবং সেটা করতে হবে অত্যন্ত দ্রুত।”
জমি অধিগ্রহণ থেকে পরিকাঠামোর অভাব। এত ‘বাধা’ সত্ত্বেও কি কোনও বিদেশি সংস্থা এ রাজ্যে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবে? মিডের মতে, হবে। যার একটা বড় উদাহরণ, জাপান। জাপানের বিভিন্ন সংস্থা অনেক দিন ধরেই পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ প্রকাশ করে আসছে। কারণ এতে তাদেরও স্বার্থসিদ্ধি হতে পারে। “কেন জানেন? আসলে চিনে তাদের কারখানার সংখ্যা কমিয়ে দিতে চাইছে জাপান। কথায় কথায় জাপানি সংস্থার কারখানা বা দফতর ঘেরাও করে চিনা শ্রমিকেরা যে-ভাবে বিক্ষোভ দেখান, তার ফলে জাপানি সংস্থাগুলি যথেষ্ট মার খাচ্ছে। তাই তারা শিল্প গড়ার জন্য নতুন জায়গা খুঁজছে। অবশ্যই ভারত, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ রয়েছে সেই তালিকার উপরের দিকে।”
মিডের মতে, রাজ্যের উন্নয়নের জন্যই অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে হবে উৎপাদন-ভিত্তিক শিল্পের উপরে। কলকাতায় আসার ঠিক আগে চেন্নাই গিয়েছিলেন তিনি। সেই প্রসঙ্গ তুলে বললেন, “বলতে খারাপ লাগছে, ওদের রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে সব কিছুই বেশ ভাল। মনে হয়, কলকাতার থেকে ওখানকার মানুষের জীবনযাপনের মান অনেক উন্নত।” কেন বলুন তো? “এর অন্যতম প্রধান কারণ, গত কয়েক বছরে কিন্তু তামিলনাড়ুতে বহু বড় বড় দেশি ও বিদেশি সংস্থা বিনিয়োগ করেছে। পশ্চিমবঙ্গের উচিত, এই ধরনের সুযোগ তাদের রাজ্যেও নিয়ে আসা। এবং সুযোগ এলে সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করা।” |