মাস দুয়েক হল দুর্গাপুর মহকুমা হাসপাতালে তৈরি হয়েছে সিক নিউ বর্ন কেয়ার ইউনিট (এসএনসিইউ)। ইতিমধ্যেই অসুস্থ শিশুর চাপ সামলাতে না পেরে ইউনিটে শয্যা (ওয়ার্মার) সংখ্যা বাড়ানোর প্রস্তাব দিলেন কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে ওই ইউনিটে ১২টি শয্যা রয়েছে। ভর্তি হয়ে গিয়েছে তার সবকটি’ই। ‘ওয়েটিং লিস্ট’ও বেশ লম্বা। পরিস্থিতি সামাল দিতে আরও ১০টি শয্যার জন্য আর্জি জানিয়ে স্বাস্থ্য দফতরে চিঠি দিয়েছেন হাসপাতাল সুপার দেবব্রত দাস।
জন্মের সময়ে নানাবিধ জটিল সমস্যায় ভোগা এক মাস বয়স পর্যন্ত শিশুদের চিকিৎসার জন্য এই বিভাগ। আগে জটিল সমস্যা নিয়ে শিশু জন্মালে তাকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল বা অন্যান্য বেসরকারি হাসপাতালে ‘রেফার’ করা হতো। আর্থিক সঙ্গতি যাদের ভাল, তাঁরা বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যেতেন শিশুদের। যারা পারতেন না, তাঁরা অনেকটা দূরে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে বাধ্য হতেন। যত সময় যেত, ঝুঁকি তত বাড়ত। পথের ধকলেই অনেক শিশু মারা যেত। মহকুমা হাসপাতালে সদ্য এই ইউনিট চালু হওয়ায় তাই স্বস্তি বাসিন্দাদের।
শহরের আইনস্টাইন অ্যাভিনিউয়ের সুদেব রায়ের মেয়ে হয়েছিল দুর্গাপুর হাসপাতালেই। জন্মের পরেই অসুস্থ সেই শিশুকে নিয়ে তাঁকে ছুটতে হয়েছিল বর্ধমান মেডিক্যালে। |
তাঁর কথায়, “প্রতি মুহূর্তে ঝুঁকি বাড়ছিল। বর্ধমানেও খুব ভিড়। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত ৮ দিন পরে মেয়ে সুস্থ হয়ে ওঠে। প্রতিদিন গড়ে ৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল। এখন তার বয়স ৫ বছর।”
হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, এই দু’মাসে এই বিভাগে ৮৪ টি শিশু ভর্তি হয়েছে। তার মধ্যে ৭টি শিশু মারা গিয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, আগে দু’মাসে গড়ে ৩০টি শিশু মারা যেত এই হাসপাতালে। হাসপাতাল সূত্রে আরও জানা গিয়েছে, এই দু’মাসে একটি শিশুকেও অন্যত্র ‘রেফার’ করা হয়নি। হাসপাতাল সুপার দেবব্রতবাবু জানান, সব শয্যা সব সময় ভর্তি। জায়গা নেই। তাই ‘ওয়েটিং লিস্ট’ তৈরি করতে হয়েছে। দেবব্রতবাবু বলেন, “এটা মোটেই কাম্য নয়। ওই পরিস্থিতিতে সময় একটা বড় ‘ফ্যাক্টর’। তাই যত তাড়াতাড়ি সেই শিশুকে এসএনসিইউতে আনা যায় তত মঙ্গল। এখানে অনেকটা জায়গা রয়েছে। তাই আরও ১০ টি শয্যা চেয়ে স্বাস্থ্য দফতরে চিঠি দিয়েছি।”
এসএনসিইউ যে শিল্পাঞ্চলের বাসিন্দাদের খানিকটা হলেও স্বস্তি দিয়েছে তা মানছেন চিকিৎসকেরাও।
হাসপাতালের চিকিৎসক তথা ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের রাজ্য সহ-সভাপতি মিহির নন্দী বলেন, “আগে এখান থেকে অসুস্থ সদ্যোজাতদের নিয়ে বাবা-মা দৌড়াতেন বেসরকারি হাসপাতালে। এখন উল্টো ছবি।” তাঁর দাবি, “কোনও বেসরকারি হাসপাতালেও এমন সুবিধা নেই।”
কিন্তু এত দিন সময় লাগল কেন শিল্পাঞ্চলের মানুষকে স্বস্তি দিতে?
হাসপাতাল সূত্রে খবর, ২০১১ সালে রাজ্যে এক সঙ্গে বহু শিশু মারা যাওয়ার পরপরই জেলা ও মহকুমা হাসপাতালগুলিতে এসএনসিইউ চালুর পরিকল্পনা নেয় রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। দুর্গাপুর মহকুমা হাসপাতালের জন্য বরাদ্দ করা হয় প্রায় দেড় কোটি টাকা। কিন্তু বিধানসভা নির্বাচন চলে আসায় দরপত্র ডাকার প্রক্রিয়াটি বিলম্বিত হয়। ফলে কাজ শুরু হতে দেরি হয়। সমস্যা দেখা যায়, জায়গা নিয়েও। এখন যেখানে এসএনসিইউ গড়া হয়েছে, হাসপাতালের মূল ভবনের পাশে সেই জায়গাটিতে বেশ কয়েকটি গাছ ছিল। গাছ কাটবে কে, এ নিয়ে টানাপোড়েন শুরু হয় পূর্ত দফতর ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মধ্যে। শেষ পর্যন্ত মহকুমাশাসকের হস্তক্ষেপে সমস্যা মেটে। কিন্তু ততদিনে গড়িয়ে গিয়েছে আরও কয়েক মাস।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১২ সালের ৩১ মার্চ ভবন নির্মাণের কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজে নেমেছিল পূর্ত দফতর। পরে তা পিছিয়ে ১ জুলাই করা হয়। জুলাই মাসে হাসপাতাল পরিদর্শনে আসে চিকিৎসক সাংসদ রত্না দে নাগের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি স্বাস্থ্য বিষয়ক ‘মাল্টি ডিসিপ্লিনারি এক্সপার্ট গ্রুপ’। রত্নাদেবী সেপ্টেম্বরের মধ্যে ইউনিটটি চালু করার পরামর্শ দিলেও তা হয়নি। শেষ পর্যন্ত এ বছরের ২৫ মার্চ নির্ধারিত সময়ের প্রায় বছর খানেক পর চালু হয় এসএনসিইউ।
নিজের মেয়ের ক্ষেত্রে এই সুবিধা পাননি। কিন্তু অবশেষে এই ইউনিট চালু হওয়ায় অনেকটা আশ্বস্ত দেখায় সুদেব রায়কে। তিনি বলেন, “আমাদের মতো পরিস্থিতিতে আর কাউকে পড়তে হবে না ভেবে ভালো লাগছে। যদি শয্যা সংখ্যা বাড়ানো হয়, তাহলে আরও অনেক বেশি মানুষ উপকৃত হবেন।” |