|
|
|
|
পঞ্চায়েত ভোটের মুখে অস্বস্তি |
জেলা পরিষদের অডিট রিপোর্টে নানা গরমিল |
নিজস্ব সংবাদদাতা • মেদিনীপুর |
পাঁচ মাস ধরে দুই মহিলা অস্থায়ী ভাবে কাজ করেছেন। পারিশ্রমিক বাবদ তাঁদের ১ লক্ষ ৪৫ হাজার টাকাও দেওয়া হয়েছে। অথচ, তাঁদের নিয়োগ সংক্রান্ত কাগজপত্র নেই! দারিদ্র্যসীমার নীচে নেই এমন ১২ হাজার (এপিএল) পরিবারকে শৌচাগার বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ জন্য ব্যয় ৪ কোটি ১৮ লক্ষ টাকা! ৬টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিকাঠামোর উন্নয়নে ব্যয় হয়েছে ২ কোটি ৮২ লক্ষ ২৬ হাজার টাকা। অথচ, এই কাজের অনুমোদনই নেই!
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পরিষদের অডিট রিপোর্টে এমনই নানা অনিয়ম সামনে এসেছে। যে সব প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে তার জন্য ব্যয় হয়েছে ১০ কোটি টাকা। রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসতেই অস্বস্তিতে পড়েছেন জেলা পরিষদ কর্তৃপক্ষ। বিশেষত পঞ্চায়েত নির্বাচন যখন দোরগোড়ায়। রিপোর্টে বলা হয়েছে, বেশ কিছু প্রকল্পে বাড়তি ব্যয় হয়েছে। আবার কিছু প্রকল্পের কাজ হয়েছে অনুমোদন ছাড়াই। দু’মাসের মধ্যে জেলা পরিষদকে জবাব দিতে হবে।
ইতিমধ্যে বাম পরিচালিত জেলা পরিষদের বিরুদ্ধে অস্বচ্ছতার অভিযোগ তুলে সরব হয়েছে তৃণমূল। দলের জেলা চেয়ারম্যান মৃগেন মাইতি বলেন, “জেলা পরিষদ নানা প্রকল্পে দুর্নীতি করেছে। তদন্ত হলে সব সামনে আসবে।” জেলা সভাধিপতি অন্তরা ভট্টাচার্যের অবশ্য বক্তব্য, “এপিএল পরিবারে শৌচাগার তৈরির ক্ষেত্রে কোনও অনিয়ম হয়নি। বলা হয়েছিল, বিপিএল তালিকায় যাঁদের নাম নেই, অথচ গরিব, তাঁদের বাড়িতে শৌচাগার করে দেওয়া যাবে।”
ঠিক কী কী অনিয়মের কথা উঠে এসেছে রিপোর্টে?
যেমন, বেশ কিছু রাস্তা সংস্কারের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, বিনপুর-বেলাটিকরি রাস্তা। রিপোর্ট অনুযায়ী, ১১ কিমি এই রাস্তা সংস্কার করতে ১৩ লক্ষ ১১ হাজার টাকা বাড়তি খরচ হয়েছে। ১০০ কিমি দূরে চন্দনপুরে স্টোন চিপস পাওয়া যায়। অথচ, এ ক্ষেত্রে ২০০ কিমি দূরে চান্ডিল থেকে স্টোন চিপস আনা হয়েছে। তপসিয়া-গোয়ালমারা, ১৫ কিমি এই রাস্তা সংস্কারের সময় এমন কিছু কাজ হয়েছে, যার অনুমোদন ছিল না। অযৌক্তিক ভাবে ২৬ লক্ষ ৮৬ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়েছে। গোয়ালতোড়-হুমগড় ১৭ কিমি এই রাস্তা সংস্কারে ৬৩ লক্ষ ৫১ হাজার টাকা খরচ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। তেমনি বড়মোড়-বালিগেড়িয়া রাস্তা সংস্কারেও ১৪ লক্ষ ৭৬ হাজার টাকা খরচে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। অন্য একটি প্রকল্পের ক্ষেত্রে ঠিকাদার সংস্থাকে অযৌক্তিক ভাবে ৩১ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে রয়েছে এপিএল পরিবারে শৌচাগার তৈরির প্রসঙ্গও। যেখানে বিপিএল পরিবারই এই সুবিধে পেতে পারে, সেখানে ডেবরা, কেশিয়াড়ি, নারায়ণগড়, দাসপুর ২-সহ ১৩টি ব্লকের ১২ হাজার ৮৭৭টি এপিএল পরিবার এই সুবিধে পেয়েছে। এর মধ্যে ১২ হাজার ৪৪৭টি শৌচাগার তৈরি হয়েছে ২০১১ সালের অগষ্ট থেকে ২০১২ সালের অগষ্টের মধ্যে। প্রতিটির জন্য খরচ হয়েছে ৩ হাজার ২০০ টাকা। বাকি ৪৩০টি শৌচাগার তৈরি হয়েছে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে। প্রতিটির জন্য খরচ হয়েছে ৪ হাজার ৬০০ টাকা।
রিপোর্ট অনুযায়ী, লক্ষ্মী নায়েক এবং আল্পনা নায়েক নামে দুই মহিলা কর্মী পাঁচ মাস ধরে অস্থায়ী ভাবে জেলা পরিষদে কাজ করেছেন। ২০১১ সালের এপ্রিল থেকে অগস্ট পর্যন্ত কাজ করেন। পারিশ্রমিক বাবদ তাঁদের ১ লক্ষ ৪৫ হাজার টাকাও দেওয়া হয়েছে। অথচ, এঁদের কী ভাবে নিয়োগ করা হয়েছে, কেন নিয়োগ করা হয়েছে, তার কোনও কাগজপত্র নেই। সঙ্গে, আরও ১১ জন কর্মীর বেতন বৃদ্ধি করা হয়েছে। তবে কীসের ভিত্তিতে এই বৃদ্ধি, তারও কোনও কাগজপত্র নেই। জেলা পরিষদের যে ছাপাখানা রয়েছে, সেখানে কাগজপত্র মজুতের ক্ষেত্রেও বহু অসামঞ্জস্য রয়েছে। যেমন একটি কাগজ ৫৬ রিম থাকার কথা। অথচ, স্টকে দেখা যাচ্ছে কাগজ রয়েছে ২২ রিম। অন্যদিকে, নজরদারির অভাবে ইন্দিরা আবাস যোজনার ৪৭ লক্ষ ৫৩ হাজার টাকা অপব্যয় হয়েছে। দেখা গিয়েছে, ২০০৯ সালে মেদিনীপুর সদর ব্লকে কংসাবতীর নদীর উপর ফেয়ারওয়েদার সেতু তৈরি হয়। খরচ হয় ২৩ লক্ষ ৫৯ হাজার টাকা। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। এক মাসের মধ্যেই কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। শেষ হয় ওই বছরের মার্চে। আর সেপ্টেম্বরের বন্যায় সেতুটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে, সেতুটি দিয়ে আর যান চলাচল করতে পারেনি। কথা ছিল, সেতুটি সংস্কারের জন্য পদক্ষেপ করা হবে। তা হয়নি। ২০১১ সালে টেকনিক্যাল অনুমোদন ছাড়াই চাঁদাবিলা, মোহাড়, সন্ধিপুর-সহ ৬টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিকাঠামো উন্নয়ন হয়। এ জন্য খরচ হয় ২ কোটি ৮২ লক্ষ ২৬ হাজার টাকা।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, একটি সংস্থা লোধা বাড়ি তৈরিতে গড়িমসি করেছে। অথছ, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ২০১১-’১২ আর্থিক বছরের এই সব তথ্য প্রকাশ্যে আসতেই অস্বস্তিতে পড়েছে জেলা পরিষদ কর্তৃপক্ষ। জানা গিয়েছে, অডিটের কাজ শুরু হয়েছিল ২০১২ সালের ৩ ডিসেম্বর। শেষ হয় চলতি বছরের ১ জানুয়ারি। এ কাজে নিযুক্ত ছিলেন সিনিয়র অডিট অফিসার গৌতম জানা, অ্যাসিস্ট্যান্ট অডিট অফিসার জগবন্ধু বারিক এবং সিনিয়র অডিটর গণপতি পোদ্দার। চলতি মাসেই এই রিপোর্ট জেলা পরিষদে জমা পড়ে। এ বার জবাব দেওয়ার পালা। রিপোর্টে যে সব প্রশ্ন তোলা হয়েছে, জেলা পরিষদ কর্তৃপক্ষ তার কী জবাব দেন, সেটাই দেখার। তবে জেলা সিপিএমের এক নেতা মানছেন, “কাজের ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। তা হলে পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হত না!” |
|
|
|
|
|