|
|
|
|
জখম আরও তিন আদিবাসী |
ছিনতাইকারী সন্দেহে গণপিটুনিতে মৃত চার |
অমিত কর মহাপাত্র • পটাশপুর |
চুরি-ছিনতাই চলছিল অনেক দিন ধরে। স্থানীয় কয়েকটি লোধা পরিবারের উপরে সন্দেহ ছিল এলাকাবাসীর। বুধবার রাতে পরপর দু’টি ছিনতাইয়ের ঘটনার পর ওই বাড়িগুলিতে একজোটে হামলা চালালেন গ্রামবাসীরা। বেধড়ক মার খেয়ে মৃত্যু হল চার আদিবাসীর। জখম হয়েছেন আরও তিন জন। বুধবার রাতে ঘটনাটি ঘটে পূর্ব মেদিনীপুরের পটাশপুর থানা এলাকার মির্জাপুর গ্রামে।
পুলিশ জানিয়েছে, নিহতদের নাম দুলাল চাতার (৪০), তপন সিংহ (৪৫), বাবলু সিংহ (৩৫) ও গোপী নায়েক (৪৫)। নিহত ও আহতেরা সকলেই মগনা পুকুর পাড়ে লোধা পাড়ার বাসিন্দা বা সম্পর্কে আত্মীয়। জখমদের মধ্যে মাকু কোল নামে এক জনকে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। গোপাল চাতার ও বাপি কোল নামে দু’জনকে এগরা মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। পরে বাপি হাসপাতাল থেকে পালিয়েছেন। থানা সূত্রে জানা গিয়েছে, ছিনতাইয়ের অভিযোগ যেমন দায়ের হয়েছে, তেমনই মারধরে মৃত্যুর অভিযোগও হয়েছে। তবে, কেউ গ্রেফতার হয়নি। এলাকায় উত্তেজনা থাকায় পুলিশি টহল চলছে।
মির্জাপুর গ্রামের মগনা পুকুর পাড়ে গত প্রায় তিন দশক ধরে বাস করছে সিংহ, চাতার, কোল, নায়েক পদবির গোটা পনেরো পরিবার। এমনিতে দিনমজুরি করে দিন কাটালেও এই পরিবারগুলি রাতের অন্ধকারে নৈপুর-সাউড়ি রাস্তায় চুরি-ছিনতাই করে বলে অভিযোগ সাঁয়া, চকগোপাল, মির্জাপুর-সহ আশপাশের গ্রামের বাসিন্দাদের। পুলিশ কোনও ব্যবস্থা না নেওয়ায় সাহস পেয়ে এরা এখন বাড়ি-বাড়ি চুরি-ডাকাতি করছে বলেও স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ। এই নিয়ে ক্ষোভ ছিল এলাকায়। বুধবার পরপর দু’টি ছিনতাইয়ের ঘটনায় সেই ক্ষোভ চরমে ওঠে। |
|
উত্তেজনা থাকায় গ্রামে পুলিশি টহল। ছবি: কৌশিক মিশ্র। |
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, সন্ধেবেলা নন্দ সাউ নামে এক ছানা ব্যবসায়ী ছিনতাইকারীদের কবল থেকে কোনও রকমে রক্ষা পান। কিছু পরে স্বপন কুমার সামাই নামে বেলদা গ্রামের এক ব্যক্তিকে ওই রাস্তাতেই পাকড়াও করে ছিনতাইকারীরা। বিশেষ কিছু না পেয়ে স্বপনবাবুকে ভোজালির কোপ মারে তারা। ছিনতাইকারীরা লোধা পরিবারের লোক ছিল বলে ছড়িয়ে পড়ে এলাকায়। আশপাশের গ্রামের লোকজনরা পুকুরপাড়ের বাড়িগুলিতে একযোগে হানা দেন। চোর সন্দেহে বেধড়ক পেটান কয়েকজনকে। ভাঙচুর চলে। খবর পেয়ে রাত ১২টা নাগাদ ঘটনাস্থলে আসে পুলিশ। গুরুতর জখম অবস্থায় পাঁচ জনকে পটাশপুর ২ ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে এগরা মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই মৃত্যু হয় বাবলু ও গোপীর। পরে আবার পুলিশ তপন ও দুলালকে উদ্ধার করে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আনে। চিকিত্সকেরা দু’জনেই মৃত বলে ঘোষণা করেন।
নিহত গোপীর শাশুড়ি শ্রীমতি চাতারের দাবি, “আমরা দিনমজুরি করি। কোনও ভাবেই চুরি-ছিনতাইয়ের সঙ্গে যুক্ত নয় আমাদের বাড়ির লোকেরা।” তাঁর অভিযোগ, “সন্দেহের বশে গ্রামের লোকেরা হামলা চালাল। আমরা ঘুমোচ্ছিলাম। বাড়ির ছেলেদের টেনে টেনে বার করে পিটিয়ে মেরে ফেলল। এমনটা মানা যায় না।”
এই ঘটনায় ক্ষোভ ছড়িয়েছে আদিবাসী সমাজেও। লোধা শবর কল্যাণ সমিতির পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক বলাই নায়েক বলেন, “সন্দেহের বশে পিটিয়ে মেরা ফেলাকে সমর্থন করা যায় না। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া হয়, এঁরা ভুল পথে গিয়েছিলেন, তা হলে এঁদের ঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা হয়নি কেন? কী করছে প্রশাসন?” চুরি-ছিনতাই রুখতে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
এগরার এসডিপিও রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের বক্তব্য, “এলাকাটি থানা থেকে ১৭-১৮ কিলোমিটার দূরে। তার উপরে ছোটখাটো চুরি-ছিনতাই হয় বলে লোকজনও সব সময় থানায় আসে না। তাই হয়তো ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।” তাঁর মতে, “এই পরিবারগুলির উন্নতিসাধনে আগে অনেক চেষ্টাই হয়েছে। কাজ হয়নি। আসলে চুরিকে অন্যায় বলে মনে করে না এরা। তবুও পরিবারগুলিকে ঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে সরকারি ভাবে পদক্ষেপ করা হবে।”
এগরার মহকুমাশাসক অসীমকুমার বিশ্বাস দায়টা কিছুটা পঞ্চায়েতের কাঁধে ঠেলে দায়সারা ভাবে বলেন, “ওখানে যে এরকম সমস্যা আছে, সেটাই জানা ছিল না। স্থানীয় পঞ্চায়েত থেকে কিছু জানায়নি আমাদের। এ বার জানলাম। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের চেষ্টা করা হবে।”
পরিবারগুলি সিপিএম সমথর্ক বলে পরিচিত। সিপিএমের পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুব্রত পণ্ডা গণপিটুনির নিন্দা করে বলেন, “দোষীদের শাস্তির পাশাপাশি ওই পরিবারগুলির ভাঙচুর হওয়া ঘরবাড়ি সরকারি ভাবে মেরামত করার দাবি জানাচ্ছি আমরা।” পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পরিষদের সহ-সভাধিপতি মামুদ হোসেনের মতে, “সমাজবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসাবে ঘটনাটি ঘটেছে। যদিও তা কাম্য নয়। এই নিয়ে রাজনীতি করাও উচিত নয়। পরিবারগুলির জন্য কী করা যায় দেখছি।” |
|
|
|
|
|