|
|
|
|
সংরক্ষণ নামমাত্র, অনাদরে পড়ে কুরুমবেড়া দুর্গ |
দেবাশিস দাস • কেশিয়াড়ি |
নিয়মমাফিক অধিগ্রহণ হয়েছে। তবে সংরক্ষণের কাজ বলতে শুধু ফলক। অনাদরেই পড়ে আছে গগনেশ্বরের কুরুমবেড়া দুর্গ। অথচ সরকার উদ্যোগী হলে এই দুর্গটিকে ঘিরে পর্যটন বিকাশ সম্ভব বলে মনে করছেন এলাকার বাসিন্দারা।
খড়্গপুর থেকে ২৭ কিলোমিটার দূরে কেশিয়াড়ি ব্লকের গগনেশ্বর গ্রামে প্রাচীন ইতিহাসের বহু উত্থান-পতনের স্মৃতিবিজড়িত এই দুর্গ। ১৯৫৮ সালের আইনানুযায়ী ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বিভাগ (আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া) ওই দুর্গ অধিগ্রহণ করে। তবে সংরক্ষণের কাজ বলতে দুর্গের কয়েকটি অংশের ভেঙে পড়া ঠেকাতে স্তম্ভ নির্মাণ ছাড়া আর কিছুই হয়নি। পর্যটন দফতরও উদ্যোগী না হওয়ায় কুরুমবেড়া দুর্গের অস্তিত্ব কার্যত সকলের অগোচরেই রয়ে গিয়েছে।
কুরুমবেড়া দুর্গের প্রতিটি অংশেই রয়েছে ইতিহাসের হাতছানি। ওই দুর্গের নির্মাণ নিয়েও বহু মত প্রচলিত। ইংরেজরা জেলার গেজেটিয়ার রচনার সময়ও এটিকে দুর্গ বলেই উল্লেখ করেছে। এই দুর্গে আসতে হলে খড়্গপুর-বেলদা রুটের বাসে কুকাই নেমে পশ্চিমে প্রায় চার কিলোমিটার দূরত্বে গগনেশ্বরে আসতে হয়। ওড়িশি স্থাপত্য রীতিতে নির্মিত আয়তাকার এই সৌধটির চার দিকেই প্রায় আট ফুট প্রশস্ত খোলা বারান্দা। এবড়ো-খেবড়ো ঝামা পাথরের উপর চুন-বালির পলেস্তারা। ১৪৩৮ থেকে ১৪৭০ সালের মধ্যে ওড়িশার রাজা কপিলেন্দ্র দেবের আমলে নির্মিত হয় এই দুর্গ। ইতিহাসবিদ রাখালদাস বল্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, গজপতি বংশের রাজা কপিলেন্দ্র দেবের রাজত্ব বিস্তৃত ছিল বর্তমান হুগলি জেলার দক্ষিণ অংশ মান্দারণ থেকে দক্ষিণ ভারতের মাদ্রাজ পর্যন্ত। |
|
দাঁড়িয়ে রয়েছে আওরঙ্গজেবের আমলে তৈরি সেই মসজিদ। —নিজস্ব চিত্র। |
সেকালে কেশিয়াড়ি ও পাশাপাশি গগনেশ্বর ছিল তসর-সিল্ক উৎপাদনের বড় কেন্দ্র। ব্যবসা-বাণিজ্যের দৌলতে এটিকে ঘিরে একদা গড়ে উঠেছিল সমৃদ্ধ জনপদ। কপিলেন্দ্র দেবের রাজত্বকালে এমন বহু দেবালয় নির্মিত হয়েছিল। কুরুমবেড়া তার অন্যতম। এই সৌধের পূর্ব দিকে রয়েছে একটি দেবালয়ের ধ্বংসস্তূপ। মন্দিরকে ঘিরে চারপাশে শরণার্থীদের থাকার জন্য ঘরও নির্মিত হয়েছিল। ‘মেদিনীপুরের ইতিহাস’ গ্রন্থের প্রণেতা যোগেশচন্দ্র বসু লিখেছেন, “...মন্দির গাত্রে উড়িয়া ভাষায় লিখিত যে প্রস্তর ফলকখানি আছে, তাহার প্রায় সকল অক্ষরই ক্ষয় হইয়া গিয়াছে, কেবল দু’একটি স্থান অপেক্ষাকৃত স্পষ্ট আছে, উহা হইতে ‘বুধবার’ ও ‘মহাদেবঙ্কর মন্দির’ এই দুইটি কথা মাত্র পাওয়া যায়।” সৌধের প্রাঙ্গণের পশ্চিম দিকে রয়েছে তিন গম্বুজ যুক্ত মসজিদ। একদা জেলা গেজেটিয়ারে লেখা হয়েছিল, সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে ১৬৯১ খ্রিস্টাব্দে জনৈক মহম্মদ তাহির এই মসজিদটি নির্মাণ করেন।
সরকারি প্রচারের অভাবে অবশ্য কুড়ুমবেড়া দুর্গের নামই শোনেননি এ রাজ্যের অধিকাংশ মানুষ। যেমন শোনেননি খড়্গপুরের মহকুমাশাসক। স্থানীয় বাসিন্দা শেখ জালালউদ্দিন বলেন, “দুর্গে পর্যটক আসেন হাতেগোনা। কুকাইয়ের পিচ রাস্তা থেকে দুর্গে আসার জন্য কোনও যানবাহনের ব্যবস্থা না থাকায় অনেকে ইচ্ছা থাকলেও আসতে পারেন না। রাস্তা পাকা না হওয়ায় বর্ষায় যাতায়াত কষ্টকর।” দুর্গের প্রাচীন পাথরের দরজা ভেঙে যাওয়ায় এখন ভরসা ভগ্নপ্রায় একটি দরজা। তাতেও তালা না থাকায় কর্মীর অনুপস্থিতিতে অরক্ষিতই থাকে এই দুর্গ। এএসআইয়ের বিষ্ণুপুর উপমণ্ডলের অন্তর্গত ওই দুর্গে নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন নিত্যানন্দ মণ্ডল। তাঁর কথায়, “পানীয় জল, শৌচাগার না থাকায় পর্যটকরা এলে অসুবিধায় পড়েন।”
গগনেশ্বর পঞ্চায়েতের সিপিএম প্রধান বুধনচন্দ্র নাগ মেনে নিয়েছেন, দুর্গকে ঘিরে পর্যটনের বিষয়ে কখনও ভেবে দেখা হয়নি। স্থানীয় গগনেশ্বর বিদ্যামন্দিরের শিক্ষক রামনারায়ন পতি জানান, দুর্গের সামনের পুকুরের চারপাশে সৌন্দর্যায়নের জন্য ২০০৭ সালে জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে ৫ লক্ষ টাকা অনুমোদিত হলেও কাজ এগোয়নি। কেশিয়াড়ি ব্লক দফতর থেকে সামনের পুকুরে পার্ক করার প্রস্তাব থাকলেও জমিসংক্রান্ত সমস্যায় তা থমকে। বিডিও অসীমকুমার নিয়োগী বলেন, “কুকাই থেকে গগনেশ্বর পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার টাকায় রাস্তা তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। দুর্গের সামনের পুকুরও সংস্কার করা হবে।”
মহকুমাশাসক আর বিমলা বলেন, “ওই দুর্গ সম্পর্কে জানা ছিল না। তবে, পর্যটন দফতরের সঙ্গে কথা বলে অবশ্যই কুরুমবেড়া দুর্গের উন্নতির বিষয়ে ভেবে দেখব।” এএসআইয়ের কলকাতা মণ্ডলের প্রধান তপনজ্যোতি বৈদ্য বলেন, “কুরুমবেড়া দুর্গের স্থাপত্য বাংলায় খুব কম দেখা যায়। ওই দুর্গে সাধ্যমতো সংরক্ষণের কাজ আমরা করেছি। কর্মী সঙ্কটের কারণে সমস্যা রয়েছে। তবে দুর্গের ভিতরে পানীয় জলের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করব।”
দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে কিন্তু অচিরেই হারিয়ে যাবে কুরুমবেড়া। |
|
|
|
|
|