উন্নয়নের নামে সবুজ ধ্বংস করে আত্মহত্যার পথে এগোচ্ছে কলকাতা— এ বার এমনই আশঙ্কার কথা জানালেন পরিবেশপ্রেমীরা।
তাঁদের বক্তব্য, শহরজুড়ে রাস্তাঘাট, উড়ালপুল, আবাসন তৈরির জন্য নির্বিচারে গাছ কাটা হচ্ছে। এক জায়গায় গাছ কাটার ক্ষতিপূরণ হিসেবে পরিপূরক গাছ রোপণ করার আইন রয়েছে। কিন্তু তা মানা হচ্ছে না বলেই অভিযোগ।
পরিবেশপ্রেমী সুভাষ দত্তের কথায়, “কোনও প্রকল্প শুরুর পর প্রাথমিক ভাবে হয়তো কয়েকটা গাছ পোঁতা হচ্ছে। তার পর সব বন্ধ। এ যেন অনেকটা শেয়ালের কুমিরছানা দেখানোর মতোই ঘটনা।”
বনাঞ্চল নয়, এমন এলাকার গাছ বাঁচাতে রাজ্য সরকারকে আইন প্রণয়নের নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। বছর পাঁচেক আগে নতুন সেই আইন চালু হয়। তাতে বলা হয়েছিল, কোনও জায়গায় গাছ কাটা হলে তার পরিপূরক হিসেবে কয়েক গুণ বেশি সংখ্যক চারাগাছ রোপণ করতে হবে। পরিবেশপ্রেমীরা বলছেন, পরিপূরক গাছ রোপণ না-করলে কী শাস্তি হবে, তা নিয়ে আইনে কিছু বলা হয়নি।
পরিপূরক গাছ লাগানোর আইনে সংশোধনের আর্জি নিয়ে তা-ই ফের আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সুভাষবাবু। তাঁর হিসেব, কয়েক বছরে কলকাতায় একের পর এক উড়ালপুল, রাস্তা তৈরি হয়েছে। গড়ে উঠেছে অনেক আবাসন। এজেসি বোস রোড, পার্ক স্ট্রিট, গড়িয়াহাট উড়ালপুল তৈরির জন্য কমপক্ষে ৩-৪ হাজার বড় গাছ কাটা হয়েছে। একের পর এক গাছ কাটা হয়েছে পার্ক সার্কাস, সুভাষ সরোবর, কাঁকুড়গাছি, সল্টলেকেও। তিনি জানিয়েছেন, আগে কলকাতায় মেহগনি, অশোক, শিমূল, পাঁকুড়, বটের মতো বড়-বড় গাছ দেখা যেত। এখন সে সবই কার্যত উধাও। |
কলকাতা পুরসভার উদ্যান বিভাগের মেয়র পারিষদ দেবাশিস কুমার অবশ্য এ সব অভিযোগ মানতে নারাজ। তাঁর দাবি, “আইন অনুযায়ী একটা গাছ কাটলে পরিবর্তে পাঁচটি গাছ রোপণ করতে হয়। কলকাতায় তার চেয়েও বেশি গাছ রোপণ করা হয়েছে। পুরসভা এ নিয়ে নজরদারিও চালায়।” দেবাশিসবাবুর হিসেবে গত বছর শহরের বিভিন্ন পার্ক, ফুটপাথ, খালের পাড় এবং রাস্তার ডিভাইডারে প্রায় ১০ হাজার চারাগাছ লাগানো হয়েছে। নিয়মিত সে সবের পরিচর্যাও করেন পুর-কর্তৃপক্ষ।
কিন্তু প্রশাসনের ওই দাবি মানতে নারাজ পরিবেশপ্রেমীদের অনেকেই।
পরিবেশকর্মী শান্তনু চক্রবর্তী বলছেন, “এ শহরে সবুজ বাঁচানোর পরিকল্পনাই তেমন নেই। উন্নয়ন হওয়াটা জরুরি। কিন্তু প্রকল্পগুলির জন্য নির্বিচারে গাছ না কেটে কয়েকটি অন্তত বাঁচানোর চেষ্টা করতে হবে।” একই সঙ্গে তিনি জানান, আইন অনুযায়ী পরিপূরক গাছ লাগানোর জন্য যতটা জায়গা প্রয়োজন, কলকাতার মধ্যে তা পাওয়া অসম্ভব। যে গতিতে উন্নয়ন চলছে তাতে
এই শহরে সবুজের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত শান্তনুবাবু। তিনি বলেন, “বায়ুমণ্ডলে প্রাকৃতিক নিয়মে ২১ শতাংশ অক্সিজেন থাকে। কিন্তু সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, কলকাতার ব্যস্ত কয়েকটি এলাকায় সেই মাত্রা ১৬-১৭ শতাংশে নেমে গিয়েছে। এটা যথেষ্টই উদ্বেগের।”
উন্নয়নের জন্য এখন বৃক্ষ-নিধন চলছে বেহালার জেমস লঙ সরণিতে। প্রশাসনিক সূত্রে জানা গিয়েছে, তারাতলা থেকে জোকা পর্যন্ত ওই রাস্তা চওড়া করার প্রকল্প শুরু হয়েছে। সে জন্য রাস্তার পাশে ৫৮৯টি গাছ কাটতে হবে। সংশ্লিষ্ট কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত পূর্ত দফতরের এক কর্তা জানান, বন দফতরের তরফে শর্তাধীন অনুমতি মিলেছে। ওই গাছগুলির পরিপূরক হিসেবে ঠাকুরপুকুর থেকে বাখড়াহাট পর্যন্ত রাস্তায় ২৯৪৫টি চারাগাছ রোপণ করা হবে।
জেমস লঙ সরণির স্থানীয় বাসিন্দারা প্রশাসনের যুক্তি মানতে নারাজ। তাঁরা বলছেন, বড়-বড় ওই সব গাছ থেকে পরিবেশের যে উপকার হত, তা চারাগাছ থেকে পাওয়া সম্ভব নয়। গরমে পূর্ণবয়স্ক ওই গাছগুলির ছায়ায় অনেকেই বিশ্রাম নেন। তা ছাড়া পরিপূরক চারাগাছগুলি যে লাগানো হবেই এবং সেগুলি বাঁচাতে সঠিক পরিচর্যা করা হবে, সে বিষয়টি নিয়েও সন্দেহে রয়েছেন সাধারণ মানুষ।
মেয়র পারিষদ দেবাশিসবাবুর বক্তব্য, “আইন সংশোধন করে আদালত পরিপূরক হিসেবে বড় আকারের গাছ লাগানো বাধ্যতামূলক করলে তা পালন করতে সমস্যা হবে না।” তিনি জানান, শহরের কয়েকটি জায়গায় সরকারি প্রকল্পের কাজের জন্য গাছ কাটা হয়েছে। ওই প্রকল্পের কাজগুলি শেষ না হওয়া পর্যন্ত পরিপূরক গাছ লাগানো সম্ভব হচ্ছে না।
পরিবেশপ্রেমীদের বক্তব্য, বর্ষার সময় অরণ্য সপ্তাহ পালন করে অনেক সংস্থাই। চারাগাছও পোঁতা হয়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেগুলির সঠিক পরিচর্যা করা হয় না। তাঁরা আরও বলছেন, উন্নয়নের কোনও প্রকল্পের জন্য গাছ কাটার প্রয়োজন হলে, প্রকল্প শুরু করার কয়েক মাস আগেই পরিপূরক গাছগুলি লাগিয়ে দেওয়া উচিত। যাতে ওই চারাগাছগুলি কিছুটা বড় হওয়ার পরেই প্রকল্পের এলাকায় পূর্ণবয়স্ক গাছগুলি কাটা হয়। এতে পরিবেশের ভারসাম্য অনেকটাই রাখা সম্ভব। |