ওরা কেউ জরির কাজ করে। কেউ কাজ করে কারখানায়। কেউ বা কোনও হোটেলে। কারও বয়স ৮, কারও ১০, কারও বা ১৪। তবে যে যেখানেই কাজ করুক, বিকেল চারটে বাজলেই ওরা এক জায়গায় হাজির। থাকবে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত। এটাই স্কুলের সময়। সেখানে মেলে খাবার থেকে হাত খরচের টাকা, বই-খাতা থেকে পেন-পেনসিল। সেই সঙ্গে মেলে শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে পড়াশোনার সুযোগ।
কিন্তু সেই সুযোগটুকুও হারাতে বসেছে ওই শিশুরা। কারণ, হাওড়ায় কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয় শিশুশ্রমিক প্রকল্পের আওতায় থাকা এই ধরনের ৪০টি শিশুশ্রমিক বিদ্যালয় অর্থাভাবে বন্ধ হতে বসেছে। অভিযোগ, কেন্দ্র টাকা না পাঠানোয় গত এক বছর ধরে বেতন হয়নি ওই স্কুলগুলির ২০০ জন শিক্ষকের। বন্ধ পড়ুয়াদের মাসিক দেড়শো টাকা ভাতাও। বন্ধ হতে বসেছে মিড-ডে মিল-ও। বিল মেটাতে না পারায় বিদ্যুৎ সংযোগও বিচ্ছিন্ন কয়েকটি স্কুলে। তাই সন্ধ্যা নামলে শহরের সর্বত্র যখন আলো জ্বলে, শিশুশ্রমিক বিদ্যালয়গুলিতে তখন জ্বলে ওঠে মোমবাতি বা হ্যাজাক। সেই আলোতেই পড়ছে খুদে পড়ুয়ারা।
এমনই দৃশ্য দেখা গিয়েছে দক্ষিণ হাওড়ার শালিমারের কাছে একটি শিশুশ্রমিক বিদ্যালয়ে। বেঞ্চের উপরে বাতি জ্বেলেই পড়ছে ছেলেমেয়েরা। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক, ওই স্কুলের এক শিক্ষক বলেন, “কেন বিদ্যুৎ নেই, আমরা বলতে পারব না। তবে এ ভাবেই আমাদের চালাতে হচ্ছে। ২০১২ সালের মার্চ মাসের পর থেকে কোনও বেতনও আমরা পাইনি। জানি না আর কত দিন এ ভাবে চলবে।” |
মোমবাতি জ্বেলে পড়াশোনা চলছে শিশুশ্রমিকদের একটি স্কুলে।
হাওড়ার শালিমারে। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার। |
এই প্রকল্পে সমস্ত টাকা আসে জেলাশাসকদের কাছে। সেখান থেকে স্কুলগুলিতে টাকা যায়। কেন হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল সেই টাকার জোগান?
হাওড়া জেলা প্রশাসনের বক্তব্য, ঠিক কী কারণে টাকা বন্ধ হয়ে গিয়েছে, তা পরিষ্কার নয়। সংশ্লিষ্ট দফতরে বারবার টাকা চেয়ে অনেক চিঠি পাঠানো হয়েছে। ফল হয়নি। হাওড়ার অতিরিক্ত জেলাশাসক (উন্নয়ন) আরশাদ হাসান ওয়ারসি বলেন, “আমরা জানিয়েছি এ ভাবে চললে সব ক’টি স্কুলই বন্ধ হয়ে যাবে। টাকা কেন আসছে না, তা জানি না। রোজই বলা হচ্ছে পাঠানো হবে। আশা করছি, খুব শীঘ্রই টাকা এসে যাবে।”
জেলা প্রশাসন সূত্রে খবর, ২০০৮ সালে জাতীয় শিশুশ্রমিক প্রকল্পের আওতায় এ রাজ্যে শিশুশ্রমিকদের নিখরচায় পড়াশোনার জন্য ৯৮৫টি স্কুল তৈরি হয়। হাওড়া জেলায় তৈরি হয় ৪০টি স্কুল। জেলাশাসকের নেতৃত্বে জেলার বিশিষ্ট মানুষদের নিয়ে তৈরি হয় শিশুশ্রমিক কল্যাণ সমিতি। ওই সমিতি আবার স্কুলগুলিকে সুষ্ঠু ভাবে পরিচালনার জন্য বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে দায়িত্ব দেয়।
হাওড়া জেলা প্রশাসন সূত্রে খবর, গত চার বছর সুষ্ঠু ভাবেই চলছিল স্কুলগুলি। শিক্ষক পদে যোগ দেওয়ার জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতার বিচারে পরীক্ষা নেন বিভিন্ন জেলার অতিরিক্ত জেলাশাসকরা। ২০০৮ সালে শিক্ষকদের বেতন ১৫০০ টাকা থাকলেও ২০১০ সালের মধ্যে তা বেড়ে হয় চার হাজার টাকা। এমনকী, পড়ুয়াদের ১০০ টাকা ভাতা বেড়ে হয় ১৫০ টাকা। পাশাপাশি, ব্যবস্থা ছিল মিড-ডে মিলেরও। কিন্তু সবই বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপদে পড়েছেন জেলার শিশুশ্রমিক স্কুলগুলির প্রায় ২০০ জন শিক্ষক। একই ভাবে সমস্যায় পড়েছে প্রায় দু’হাজার দরিদ্র পড়ুয়াও। |