|
|
|
|
সম্পাদকীয় ১... |
রাস্তা ছাড়ুন |
শ্যামবাজারের পর হাজরা মোড়। সি পি আই এমকে জনসভা আয়োজনের অনুমতি দিতে পুলিশের আপত্তি লইয়া আবার প্রশাসনিক পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ। এই অভিযোগটিকেই সাক্ষ্য মানিয়া পুলিশ তথা পুলিশমন্ত্রী তথা তাঁহার প্রশাসন প্রথমেই দাবি করিতে পারে যে, অন্তত একটি ব্যাপারে তাহারা কোনও পক্ষপাত ঘটায় নাই— উত্তর কলিকাতাতেও জনসভায় আপত্তি করিয়াছিল, দক্ষিণ কলিকাতাতেও করিয়াছে। কলিকাতার উত্তর-দক্ষিণ বিবাদ, অধুনা কিঞ্চিৎ স্তিমিত হইলেও, দুর্মর। তদুপরি, বুদ্ধদেববাবুর পুরানো পাড়ায় বাম সভার অনুমোদন মিলিল না, আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের খাসতালুকে কাস্তে হাতুড়ি তারা স্বাগত হইল— এমনই বা হইল কী করিয়া? দুই বছর আগে যখন মুখ্যমন্ত্রী সদ্য মহাকরণে অধিষ্ঠিতা হইয়াছিলেন, যখন তাঁহার চোখে সকলই নবীন সকলই বিমল বলিয়া প্রতিভাত হইয়াছিল, সেই সময় এমন সভার অনুমতি চাহিলে, অথবা না-চাহিলেও, হয়তো তিনি বিমান-বুদ্ধদেবাদিদেবগণকে সাদর অভ্যর্থনা জানাইতেন, এমনকী বিধ্বস্ত বামপন্থীরা অনুরোধ করিলে ছোট ছোট তাজা ভাইদের দিয়া ম্যারাপও বাঁধাইয়া দিতেন। কিন্তু জীবন গিয়াছে চলি... সি পি আই এম মুখে যাহাই বলুক, শ্যামবাজারের পরে হাজরা মোড়ে অন্য ইতিহাস রচিত হইবে, এমন প্রত্যাশা বোধহয় তাহারা নিজেরাও করে নাই। অতএব আবার ম্যাটাডর ভ্যানের প্রস্তুতি চলিতেছে। গৌতম দেবরা ভাবিয়া দেখিতে পারেন, সভামঞ্চের বিকল্প হিসাবে এই যান-মঞ্চটিকেই বাছিয়া লইবেন কি না, রথী-মহারথী ভাবটি তাহাতে আরও প্রজ্বলিত হইবে। তাহা ছাড়া, ভোটে হারিয়া তাঁহাদের দলটি যেমন ভাবে বসিয়া পড়িয়াছে, তাহাতে আপাতত ম্যাটাডরই শ্রেয়— বিরোধিতার মঞ্চটি অন্তত জঙ্গম হউক।
কিন্তু প্রশাসনিক পক্ষপাতিত্ব? সেই অভিযোগ তো অহেতুক নহে। বিরোধী দল সভা করিতে চাহিলেই পুলিশ ঘাড় নাড়িবে, তাহা কেমন কথা? তাহা হইলে উপায়? ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ অনুসরণ করিয়া সর্ব দলের প্রতি সমান দাক্ষিণ্য প্রদর্শনই নিরপেক্ষতার প্রশস্ত উপায়? সহজ উত্তর: না। বরং পশ্চিমী ধর্মনিরপেক্ষতার পথে হাঁটিয়া সর্ব দল হইতে দূরে থাকাই এই ক্ষেত্রে যথার্থ পথ। দূরে থাকা না বলিয়া দূরে রাখা বলা অধিক সঙ্গত। পুলিশ-প্রশাসন বিরোধীদের সভামঞ্চকে রাজপথ হইতে দূরে রাখিতে চাহিয়াছে, অতি উত্তম। তাহারা সমস্ত দলের সভাকে রাজপথ হইতে দূরে রাখিলে সর্বোত্তম হইবে। বস্তুত, কেবল সভা নহে, রাস্তায় যে কোনও দখলদারি বন্ধ করাই প্রশাসনের কর্তব্য। পূজামণ্ডপ হইতে রবীন্দ্র জন্মোৎসব, কোনও অনুষ্ঠানই রাস্তায় আয়োজন করা বিধেয় নহে। রাস্তা চলাচলের জন্য। কলিকাতা শহরে এই বিষয়ে বিস্তর শোরগোল হইয়াছে, বিস্তর ঘটনা ঘটিয়াছে, শাসক জোটের প্রধান শরিক দলের কর্তাব্যক্তি আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত হইয়াছেন, কালক্রমে যত্রতত্র জনসভা আয়োজনে কিছু সংযমও হয়তো আসিয়াছে, শহরের প্রাণকেন্দ্রকে দিনের পর দিন বিপর্যস্ত করিয়া পুস্তকমেলা আয়োজনের প্রথা বিদায় লইয়াছে। কিন্তু বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত উন্নতি যথেষ্ট নহে। প্রয়োজন আমূল সংস্কার। কোনও রাস্তা কোনও কারণে কখনও বন্ধ করা যাইবে না, ইহাই হওয়া উচিত নীতি। অলঙ্ঘনীয় নীতি।
পূজামণ্ডপ হইতে রবীন্দ্রজন্মোৎসব, কোনও অনুষ্ঠানের আয়োজকরাই এই নীতি মানিতে চাহিবেন না। তাঁহাদের মানিতে বাধ্য করাই প্রশাসনের কাজ। কাজটি সহজ হইবে, যদি রাজনৈতিক দলগুলি ক্ষুদ্রস্বার্থ ভুলিয়া এই কাজে প্রশাসনের পাশে দাঁড়ায়। রাস্তা জুড়িয়া জনসভা (অথবা সামাবেশ, অবস্থান, মিছিল ইত্যাদি) করিবার পিছনে দলীয় স্বার্থ নিতান্তই ক্ষুদ্র। জনসংযোগ বা নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য জনজীবন পণ্ড করিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন হয় না, তাহার অন্য অনেক সভ্য উপায় আছে। রাস্তা বন্ধ করিয়া রাজনীতি করিবার প্রকৃত কারণ একটিই— ইহাতে সহজে এবং সস্তায় বহু মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। সস্তায় বাজিমাত করা বর্তমান দলীয় রাজনীতির ধর্মে পরিণত হইয়াছে। ইহা অধর্ম। ম্যাটাডরে চড়িয়া ভিড় জমাইয়া রাস্তা বন্ধ করিলেও সেই অধর্মের আশ্রয় লওয়া হয়। রাজনীতিকরা ম্যারাপ বাঁধিবেন না রথে চড়িবেন, তাহা তাঁহাদের অভিরুচি। কিন্তু রাস্তা ছাড়িয়া দিন। |
|
|
|
|
|