বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পুকুরে দুধ-জল ঢেলেও ডিম পাড়েনি ইলিশ
রোজ সকালে ত্রিবেণীর ঘাটে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকতেন তিনি। নৌকায় তোলার আগেই জেলেদের জাল থেকে জ্যান্ত ইলিশ বার করে নিতেন। নদী থেকে মাছ তুলে রাখা হত বড় বড় ড্রামে। তাতে থাকত দুধ মেশানো জল। বেশ ক’দিন পরে ড্রাম থেকে তুলে সেই ইলিশ নিজেদের পুকুরে ছাড়তেন মগরার শ্যামাচরণ চট্টোপাধ্যায়।
একটা-দু’টো নয়। স্ত্রী-পুরুষ মিলিয়ে এই ভাবে প্রায় ৪০টি ইলিশ পুকুরে ছেড়েছিলেন শ্যামাচরণবাবু। নিছক খেয়াল নয়। কেন্দ্রীয় সরকারের একটি প্রকল্প চলছিল তখন। ২৯ বছর আগের কথা।
সেই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল, পুকুরে ইলিশের চাষ করা। তিন বছর মাছগুলো বেঁচেছিল শ্যামাচরণবাবুর পুকুরে। কিন্তু একটি স্ত্রী মাছের পেটেও ডিম আসেনি। ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৭ মৎস্যবিজ্ঞানীরা অনেক চেষ্টা করেও এই তিন বছরে পুকুরে ইলিশের প্রজনন ঘটাতে পারেননি। তাই কেন্দ্রীয় সরকারের ওই প্রকল্পটিকে এক সময় বাতিল বলে ঘোষণা করা হয়। ইলিশগুলিও মারা যায় মগরার পুকুরেই।
মগরায় ইলিশ মাছের কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র। —নিজস্ব চিত্র
মঙ্গলবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষণা শ্যামাচরণবাবুর স্মৃতিকে উস্কে দিয়েছে। মমতা চান, ইলিশের জোগান বাড়াতে ব্রয়লার মুরগি, হাঁস, গরু কিংবা চিংড়ির মতো ইলিশেরও কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র তৈরি হোক রাজ্যে। আর সেই কেন্দ্রে উৎপাদন হোক টন টন ইলিশ। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর এই ইচ্ছা পূরণ আদৌ সম্ভব কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মৎস্যবিজ্ঞানী মহল।
তিন দশক আগেও ইলিশের কৃত্রিম প্রজনন নিয়ে গবেষণা শুরু হওয়ার সময় একই প্রশ্ন উঠেছিল বলে শ্যামাচরণবাবু বুধবার জানান। তিনি বলেন, “আমরা একটা চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলাম। মৎস্য দফতরের বিজ্ঞানীরা এসে জল পরীক্ষা করে যেতেন। মাঝে মাঝে পুকুরে দুধ জল ঢালতে হত। অন্য মাছের সঙ্গে দিব্যি ছিল ইলিশগুলো।”
২৫০ থেকে ৫০০ গ্রাম পর্যন্ত ওজনের মাছগুলি দেখতে দিল্লি এবং অন্য রাজ্যের মৎস্যবিজ্ঞানীরাও আসতেন। বেশ কয়েক বার গিয়েছিলেন রাজ্যের তৎকালীন মৎস্যমন্ত্রী কিরণময় নন্দও। কিরণময়বাবু বলেন, “দুধ-জল দিলে ইলিশ মাছের ঝকঝকে রুপোলি রঙটা স্থায়ী হয়। তাই মৎস্যবিজ্ঞানীদের পরামর্শ মতো মাছগুলিকে পুকুরে ছাড়ার আগে দুধ মেশানো জলে রাখা হত। মাছ বেঁচে গেলেও প্রকল্পের আসল উদ্দেশ্যটা কিন্তু সফল হয়নি।”
শুধু শ্যামাচরণবাবুর পুকুর নয়, ইলিশ মাছের কৃত্রিম প্রজনন নিয়ে গবেষণা হয়েছিল নৈহাটিতে রাজেন্দ্রপুরের একটি মৎস্য প্রজনন কেন্দ্রেও। ওই কেন্দ্রের এক প্রাক্তন কর্মী বলেন, “ওখানে ছোট মাছ বড় হয়েছিল। কিন্তু ডিম হয়নি স্ত্রী মাছের। আর পুকুরে বেড়ে ওঠা ইলিশের স্বাদও মুখে দেওয়ার মতো হয়নি। তাই ওই প্রকল্প এক সময় বন্ধ হয়ে যায়।” কিরণময়বাবু জানান, মগরা-নৈহাটির মতো ব্যারাকপুরে কেন্দ্রীয় সরকারের মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রেও ইলিশ প্রজনন নিয়ে গবেষণা হয়েছিল বছর দশেক আগে। সেটাও সফল হয়নি। ওই গবেষণা কেন্দ্রের অবসরপ্রাপ্ত এক গবেষক বলেন, “আলাদা করে ট্যাঙ্ক বানিয়ে সেখানে জলের স্রোত দিয়ে ইলিশের প্রজননের চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই মাছ মরে যায়।”
রাজ্য মৎস্য দফতরের কর্তারা ইলিশ প্রজননের ব্যাপারে এই সব অতীত অভিজ্ঞতার কথা জানেন। তাই মঙ্গলবার মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা শুনে তাঁদের নাওয়া-খাওয়া বন্ধ হওয়ার জোগাড় হয়েছে। এখন কী করণীয়, তাই নিয়ে কেন্দ্রীয় মৎস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করেছেন তাঁরা। মৎস্যমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী তাঁর ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন। আমরা মৎস্য দফতরের প্রাক্তন এবং বর্তমান বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলছি।” মৎস্য দফতরের এক কর্তা বলেন, “আমরা এ ব্যাপারে বিভিন্ন মৎস্য বিশেষজ্ঞকে নিয়ে কমিটি তৈরি করব। রিপোর্ট সন্তোষজনক হলে তবেই এগোনো হবে।”
কিন্তু ইলিশ মাছের কৃত্রিম প্রজনন কিছুতেই সফল হচ্ছে না কেন? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান বিভাগের মৎস্য বিশেষজ্ঞ, অধ্যাপক সুমিত হোমচৌধুরী জানান, ইলিশ মাছের জীবনচক্র খুব জটিল। প্রধানত নোনা জলের মাছ। প্রজনন এবং ডিম দেওয়ার জন্য বিশেষ সময়ে ইলিশকে স্বাদু জলে আসতে হয়। যাত্রাপথে পদে পদে জলের লবণের পরিমাণ, তাপমাত্রা এবং আরও অনেক রাসায়নিক পরিবর্তন হয়ে থাকে। সেই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হয় ইলিশকে।
সুমিতবাবুর ব্যাখ্যা, “জলের রাসায়নিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ইলিশেরও বিভিন্ন জৈবিক পরিবর্তন হয়। প্রজনন ও ডিম উৎপাদনের জন্য এই পরিবর্তনগুলিই একান্ত সহায়ক। কৃত্রিম প্রজননে এই জৈবিক প্রক্রিয়াগত পরিবর্তন আসে না। সেই অসম্ভবকে সম্ভব করতে আরও গবেষণার প্রয়োজন।” সুমিতবাবুরা জানতে পেরেছেন, আমেরিকার এক ফিশারি ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা স্যামন মাছের উপরে গবেষণা করে তাদের দীর্ঘ যাত্রাপথে কী কী জৈবিক পরিবর্তন হয়, তা জানা গিয়েছে বলে দাবি করেছেন। ওই বিজ্ঞানীদের দাবি, তাঁরা স্যামনের কৃত্রিম প্রজনন ঘটাতেও সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু এ দেশে সেই মানের গবেষণার পরিকাঠামো এখনও গড়ে ওঠেনি বলে সুমিতবাবু মন্তব্য করেন।
তবে স্যামনের উপরে পরীক্ষানিরীক্ষাকে কেন্দ্র করেই ব্যারাকপুরের কেন্দ্রীয় মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রের নদী-মৎস্য বিভাগের প্রাক্তন প্রধান উৎপল ভৌমিক অবশ্য ইলিশের ব্যাপারেও কিছুটা আশাবাদী। তিনি বলেন, “বাংলাদেশে এবং আমাদের গবেষণাগারে বেশ কিছুদিন ধরেই নরওয়ের সঙ্গে যৌথ ভাবে এ নিয়ে কাজ হচ্ছে। ভারত-বাংলাদেশ-নরওয়ের মধ্যে চুক্তি হয়েছে। নরওয়েতে স্যামন মাছের উপরে গবেষণায় যে সাফল্য মিলেছে, সেই পথেই আরও কিছু দিন গবেষণা চললে এ ব্যাপারে সব প্রতিবন্ধকতা দূর করা যাবে বলে মনে হয়।”
ব্যারাকপুরের ওই মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রের এক বর্তমান কর্তা কিন্তু উৎপলবাবুর কথায় আমল দিতে রাজি নন। তিনি বলেন, “ইলিশ এক ধরনের পরিযায়ী মাছ। সমুদ্র থেকে নদীতে আসে। প্রজনন-পর্ব শেষ করে ফিরে যায় সুমদ্রেই। তাই ইলিশকে এক জায়গায় ধরে রেখে তার কৃত্রিম প্রজননের চেষ্টা করা মানে প্রাকৃতিক নিয়মের বিরুদ্ধে যাওয়া।”
ওই গবেষণা কবে সফল হবে তার জন্য অপেক্ষা করে লাভ নেই বলে মন্তব্য করে ওই মৎস্যবিজ্ঞানীর আর্জি, “ছোট ছোট ইলিশ ধরা বন্ধ করার ব্যবস্থা করুক সরকার। গঙ্গা দূষণ কমানোর চেষ্টা হোক। তা হলেই বাঙালি আবার দেখতে পাবে প্রমাণ সাইজের ইলিশ। রসনা তৃপ্ত হবে।”




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.