দুটি ঘুলঘুলি দিয়ে সকালের কিছুটা সময় রোদ ঢোকে ঘরটায়। তার জালি দিয়ে ঘেরা জানালা। একতলার ঘরে দিনের বাকিটা সময় গুমোট অন্ধকার। সর্বক্ষণ দরজা তালা বন্ধ। মানসিক ওয়ার্ডে এই ঘরেও দিন কাটছে রেশমি আর সীতার। যদিও হাসপাতাল থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁরা সুস্থ। গত ৪ মে তাদের ছুটিও লিখে দিয়েছেন হাসপাতালের চিকিৎসক। তবু টানা ১৬ দিন ধরে তাঁরা জলপাইগুড়ি সদর হাসাপাতালের হাসপাতালের মানসিক বিভাগেই বন্দি রয়েছেন। রাজ্য মহিলা কমিশনের সদস্যা জ্যোৎস্না অগ্রবাল বলেন, “এ তো খুবই দুঃখজনক ঘটনা। দুই মহিলাকে হাসপাতাল থেকে অন্য হোমে না পাঠিয়ে বাড়ি ফেরাতে হবে। আমি এ বিষয়ে প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলব।” কারণ, ময়নাগুড়ির ক্ষণিকালয় নামে যে হোমে তাঁরা ছিলেন, সেখানে পরিকাঠামোর অভাবে তাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় বলে লিখিত ভাবে হোম কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন। তাই আপাতত মানসিক ওয়ার্ডই তাদের ঠিকানা। সেই ঘরে কার্যত বন্দি রেশমি নাসর্দের ডেকে নেপালের পাহাড়ি রাস্তায় তার ছোটবেলায় দৌড়ে বেড়ানোর কথা বলে বেড়ান। বাড়ি যাওয়ার আবদারও করেন ২০ বছরের যুবতী রেশমি। সারা দিন জানালার সামনে দাড়িয়ে থেকে সীতা তাঁর সদ্যোজাত শিশুর কথাই ভাবে।
দুজনকেই চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ময়নাগুড়ির ক্ষণিকালয় হোম থেকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, হিংসাত্মক আচরণের জন্য দুই মহিলাকে হাসপাতালে পাঠানো হয় কথাবার্তায় কিছুটা অসংলগ্নতা থেকে গেলেও প্রায় তিন মাসের চিকিৎসার পরে বর্তমানে তাঁরা অনেকটাই সুস্থ। মানসিক চিকিৎসকও লিখে দিয়েছেন। এই অবস্থায় তাঁদের মানসিক ওয়ার্ডে থাকার দরকার নেই। মানসিক ওয়ার্ডে বন্দি থাকলে ফের অসুস্থ হয়ে পড়ার আশঙ্কাও রয়েছে বলে চিকিৎসকরা লিখিত জানিয়ে দিয়েছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চিঠি দিয়ে জেলাশাসকের দফতরে বিষয়টি জানিয়েছেন।
জেলাশাসক স্মারকী মহাপাত্র বলেন, “ওঁদের কলকাতার কোনও মানসিক চিকিৎসার হোমে পাঠানোর ব্যবস্থা করা সম্ভব কি না দেখা হচ্ছে। তবে তাদের যাতে হাসপাতালের মানসিক বিভাগে বন্দি দশায় না থাকতে হয় সে জন্য সমাজকল্যাণ আধিকারিককে নির্দেশ দিয়েছি।” ক্ষণিকালয় হোমের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক বিশ্বজিৎ দত্ত বলেন, “ওই দুই মহিলাকে হিংসাত্মক আচরণের জন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। হাসপাতাল থেকে কিছুদিন আগে তাঁদের ছুটির কথা জানানো হয়েছে। কিন্তু আমাদের হোমে মানসিক রোগীদের রাখার পরিকাঠামো নেই। আমাদের পক্ষে রাখা সম্ভব নয়।”
চলতি বছরের প্রথম দিকে জেলার হাসিমারা এলাকা থেকে অর্ধনগ্ন অবস্থায় নেপালের বাসিন্দা ২০ বছরের এক যুবতীকে উদ্ধার করা হয়। স্থানীয় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে যুবতীকে ক্ষণিকালয় হোমে পাঠানো হয়। শামুকলতা এলাকায় উদ্দেশ্যহীন ভাবে এক গর্ভবতী মহিলাকে ঘুরতে দেখে স্থানীয় একটি সংস্থা হাসপাতালে ভর্তি করায়। হাসপাতালে প্রসব হওয়ার পরে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমে জেলা শিশু কল্যাণ কমিটি মহিলার শিশুপুত্রকে একটি সরকার অনুমোদিত সদ্যোজাত শিশুদের হোমে পাঠিয়ে দেয় ও মহিলাকে ময়নাগুড়ির ক্ষণিকালয় হোমে পাঠানো হয়।
সোমবার হাসপাতালের মানসিক ওয়ার্ডে নেপালের বাসিন্দা রেশমি অস্পষ্ট হিন্দিতে বলে, “আমার এক দাদা ঘুরতে যাওয়ার নাম করে আমাকে এখানে নিয়ে আসে।” বাড়ির কে কে আছেন জানতে চাইতেই গলা ধরে আসে রেশমির। তিনি বলেন, “আমার কাঠমান্ডুতে বাড়ি। বাবা-মা আছে। বাড়িতে একটা বাগান আছে। সেখানে কত রঙের ফুল ফুটত। পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন সীতা দেবনাথ। তিনি বলেন, “আমার পদবি দেবনাথ নয়, দেবশর্মা. হাসপাতালের কাগজে ভুল লেখা আছে।” সীতার প্রশ্ন, “আচ্ছা আমার ছেলেটা কোথায় আছে? ওকে কেউ যত্ন করছে তো? আমাকে এখানে কেন বন্ধ করা হয়েছে? অসমের রাজতলিতে আমাদের বাড়ি. স্বামী মারত বলে চলে এসেছিলাম। পুরো ঠিকানাটা চেষ্টা করলে মনে আসবে। বাবাকে কেউ খবর দিলেই আমাকে নিয়ে যাবে।” |