শর্তরক্ষায় প্রস্তাব রাজ্যের |
জনতাকে রেহাই দিয়ে জলকর শুধু জল-শিল্পে |
সঞ্জয় চক্রবর্তী • কলকাতা |
অনেকটা বলা যায়, ঘুরিয়ে নাক দেখানোর মতো!
রাজ্য সরকারের নীতি হল, সাধারণ মানুষের থেকে জলকর নেওয়া হবে না। অথচ কেন্দ্রীয় জওহরলাল নেহরু ন্যাশনাল আর্বান রিনিউয়াল মিশন (জেএনএনইউআরএম)-এর আওতাধীন জল-প্রকল্পে অর্থ মঞ্জুরির শর্তই হল, প্রকল্প রক্ষণাবেক্ষণের স্বার্থেই তার জল ব্যবহার বাবদ ব্যবহারকারীদের থেকে কর আদায় করতে হবে। এই দ্বিমুখী সঙ্কটের পরিত্রাণে রাজ্য সরকার যে পন্থা উদ্ভাবন করেছে, তাতে আপাতদৃষ্টিতে আমজনতার ঘাড়ে করের বোঝা না-চাপলেও তার আঁচ গায়ে লাগার সম্ভাবনা একটা থেকেই যাচ্ছে। আর তাই প্রশ্ন উঠেছে, এর পরিবর্তে সরাসরি সব গ্রাহককে জলকরের আওতায় নিয়ে আসাটা বেশি সহজ ও স্বচ্ছ হতো না কি?
রাজ্য স্থির করেছে, তারা সাধারণের উপরে জলকরের ভার না-চাপিয়ে টাকাটা পরোক্ষে তুলবে বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস্থার কাছ থেকে। এ ক্ষেত্রে মূলত পরিশুদ্ধ পানীয় জল (মিনারেল ওয়াটার) ও অন্যান্য পানীয় প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলিই সরকারের লক্ষ্য। বর্তমানে তারা যে সব গভীর নলকূপের সাহায্যে নিজেদের প্রয়োজন মেটায়, তা বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হবে। নতুন করে ডিপ টিউবওয়েল বসানোর অনুমতিও দেওয়া হবে না। সংস্থাগুলিকে বলা হবে জেএনএনইউআরএমের জল-প্রকল্প থেকে সরাসরি জল কিনে উৎপাদন চালাতে। ওদের ব্যবসা করতে দেওয়ার অন্যতম শর্তই হবে, সরকারি জল-প্রকল্প থেকে জল কেনা। এতে এক ঢিলে দুই নিশানা হাসিল হবে বলে নগরোন্নয়ন দফতর-সূত্রের দাবি।
কী রকম? সূত্রটির ব্যাখ্যা: ওই ধরনের বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস্থা যে ভাবে অজস্র গভীর নলকূপ বসিয়ে ভূগর্ভের জল যথেচ্ছ টেনে নিচ্ছে, তাতে এক দিকে যেমন মাটির নীচের জলস্তর নেমে যাচ্ছে, অন্য দিকে আর্সেনিক, ফ্লুওরাইড দূষণের আশঙ্কা দিন দিন বাড়ছে। গভীর নলকূপগুলি বন্ধ হলে সেই বিপদ অনেকাংশে প্রতিরোধ করা যাবে। আবার পরিবেশরক্ষার পাশাপাশি সংস্থাগুলোকে জল বেচলে জল-প্রকল্প রক্ষণাবেক্ষণের টাকা উঠে আসবে, পূরণ হবে কেন্দ্রীয় শর্তও।
কিন্তু জলের পিছনে বাড়তি দাম গুনতে হলে সংস্থাগুলো যে ক্রেতাদের থেকে তা তুলে নেওয়ার চেষ্টার কসুর করবে না, প্রশাসনের একাংশ তা মানছেন। সে ক্ষেত্রে অর্থনীতির নিয়মেই সাধারণ মানুষের উপরে তার একটা প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে। অর্থাৎ, বোতলবন্দি মিনারেল ওয়াটার বা নরম পানীয়ের দাম বাড়লে পরোক্ষে তার ভার আমজনতার একাংশকেই বইতে হবে বলে ওঁরা স্বীকার করছেন। এর বদলে শিল্প, গৃহস্থ সব গ্রাহকের উপরে সরাসরি জলকর বলবৎ হলে যুক্তি ও স্বচ্ছতার নিরিখে তা বেশি বাস্তবোচিত হতো বলেও অভিমত প্রশাসনের একাংশের।
রাজ্যের তৈরি প্রস্তাবে কেন্দ্রীয় সরকার কি রাজি হবে? প্রশাসনের খবর: এই মর্মে দিল্লিতে প্রস্তাব পাঠানো হচ্ছে। কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রক আপত্তি করবে না বলেই দফতরের আশা। দিল্লির সবুজ সঙ্কেত মিললে রাজ্য এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট বিধি তৈরি করবে। রাজ্যের পুর-নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের দাবি, কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের সঙ্গে কথাবার্তার ভিত্তিতেই রাজ্য বিষয়টি নিয়ে উদ্যোগী হয়েছে। “এই মুহূর্তে জেএনএনইউআরএমের অধীনে পশ্চিমবঙ্গে ২৩টি জল-প্রকল্প তৈরি হচ্ছে। প্রস্তাবটি কার্যকর হলে তার রক্ষণাবেক্ষণের খরচও অনেকটা উঠে আসবে।” বলেন মন্ত্রী। উল্লেখ্য, জেএনএনইউআরএম প্রকল্পে উৎপাদিত জল পাউচে ভরে বিক্রির পরিকল্পনাও নগরোন্নয়ন দফতরের মাথায় আছে। বিভিন্ন আর্সেনিকমুক্ত জল-প্রকল্প থেকে ইতিমধ্যে পাউচে ভরা পরিশুদ্ধ পানীয় জল বিক্রি শুরুও করে দিয়েছে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর। জল বিক্রির টাকা তারা প্রকল্প দেখভালে লাগিয়ে থাকে।
তবে নগরোন্নয়ন দফতরের দাবি: কর আদায়ের বাধ্যবাধকতা বাদ দিলেও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার প্রেক্ষাপটে বিচার করলে নতুন সিদ্ধান্তটি যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। উদাহরণ হিসেবে দক্ষিণ শহরতলিতে একটি পানীয় কারখানার আশপাশের জলসঙ্কটের প্রসঙ্গ তুলেছেন নগরোন্নয়ন-কর্তারা। তাঁদের এক জনের মন্তব্য, “নির্বিচারে ভূগর্ভের জল তুলে নেওয়ায় যেখানে যেখানে জলস্তর নামছে, তার অনেকগুলো আর্সেনিকপ্রবণ এলাকা। ওখানে বিপদটা আরও বেশি।” দিল্লিতে পাঠানো প্রস্তাবে এই বিষয়টিতে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে বলে নগরোন্নয়ন দফতরের খবর। বাণিজ্যিক সংস্থাগুলো কি এ ভাবে জল কেনার শর্ত মানতে রাজি হবে?
পানীয় প্রস্তুতকারী এক সংস্থার একটি সূত্র বলেন, “আগে সরকার বিধি বানিয়ে জানাক। তার পরে আমরা আমাদের বক্তব্য জানিয়ে দেব।” |