দফা কিংবা দিন নিয়ে বিরোধ আপাতত মিটেছে। জেলাবিন্যাস নিয়ে মহাকরণের সূত্রও আপাতত মেনে নিয়েছে রাজ্য নির্বাচন কমিশন। তা মেনে এ সপ্তাহেই জারি হতে চলেছে বিজ্ঞপ্তিও। তবে এত কিছুর পরেও ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে পঞ্চায়েত ভোট-পর্ব শেষ হওয়া নিয়ে সংশয় কাটছে না। কারণ প্রথম দফার ভোটে যে ৭৫ হাজার অতিরিক্ত পুলিশ লাগবে, তা কোথা থেকে আসবে, সে জবাব এখনও দিতে পারেনি সরকার। রাজ্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করতে পারলে কমিশন ভোট করানোর প্রশ্নে ফের আইনি পথে হাঁটবে বলেই কমিশন সূত্রের খবর।
কী সেই আইনি পথ? কমিশনের বক্তব্য, পঞ্চায়েত ভোট হচ্ছে আদালতের নির্দেশে। সেখানে আদালত নিরাপত্তার যে ব্যবস্থা করতে বলেছে, তা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা হবে। সরকারও আদালতকে তা জানিয়েছে। এখন রাজ্য যদি নিরাপত্তা বাহিনী দিতে না পারে, তা হলে কমিশন ভোট প্রক্রিয়া চলাকালীন আপৎকালীন পরিস্থিতি হলে (যেমন ভূমিকম্প, বন্যা, খরা-সহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় ইত্যাদি) যে ব্যবস্থা নেয়, তা নিতে বাধ্য হবে। তা হল, ভোট স্থগিত করে দেওয়া। আদালতের কাছেও পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করবে কমিশন।
প্রশ্ন উঠেছে, প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা আপৎকালীন অবস্থা আর নিরাপত্তা বাহিনী না পাওয়া কি এক? কমিশনের ব্যাখ্যা, আদালত-নির্দিষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে ভোট করার কথা রাজ্য এবং কমিশন উভয়েই মেনে নিয়েছে। সেই নিরাপত্তা বাহিনী দেওয়া রাজ্যের দায়িত্ব। তা না পাওয়া গেলে এক দিকে যেমন আদালতের নির্দেশ অবমাননা করা হবে, অন্য দিকে আইন-শৃঙ্খলার প্রশ্নেও বড় ঝুঁকি নেওয়া হয়ে যাবে। কমিশন দু’টির কোনওটিই করতেচায় না। তাই রাজ্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে না পারলে তাকে আপৎকালীন পরিস্থিতি বলেই ব্যবস্থা নেবে কমিশন।
নিরাপত্তা বাহিনীর ঘাটতি নিয়ে কমিশন কি সরকারকে চিঠি দিয়েছে? রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে বলেন, “রাজ্যকে চিঠি দিয়ে কোথা থেকে ফোর্স আসবে, তা খুব শীঘ্রই আমরা জানতে চাইব। পাশাপাশি ভোটের বিজ্ঞপ্তিও জারি হবে। তবে মাথায় রাখতে হবে, নিরাপত্তার বিষয়টি ভীষণ জরুরি।” স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা বলেন, “কমিশন থেকে আমরা দু’টো চিঠি পাব। একটি বিজ্ঞপ্তি জারির, অন্যটি নিরাপত্তা বাহিনী সংক্রান্ত। চিঠি দু’টি আসার পরেই সরকার পদক্ষেপ করবে।” সরকারের এক শীর্ষ সূত্রের অবশ্য দাবি, ভোট করানোর জন্য বাইরে থেকে কোনও বাহিনী আনার প্রয়োজন নেই। জঙ্গলমহলে এমনিতেই আধাসেনা রয়েছে। আর প্রথম দফার বাকি ৬ জেলায় রাজ্য পুলিশের সঙ্গে সিভিক পুলিশ, ভিলেজ পুলিশ এবং হোমগার্ডদের নিলেই কাজ মিটে যাবে বলে ওই শীর্ষ সূত্রের বক্তব্য। কমিশন অবশ্য আগেই জানিয়ে দিয়েছে, সশস্ত্র পুলিশ মানে সশস্ত্র পুলিশই। অন্য কোনও ধরনের ‘আধা-পুলিশ’ দিয়ে ভোট করানো যাবে না।
নিরাপত্তার বিষয়টি স্পষ্ট না করেই কমিশন কেন ভোটের বিজ্ঞপ্তি জারি করছে? একাধিক সরকারি সূত্রে বলা হচ্ছে, হাইকোর্টের রায়ে কমিশন কিছুটা কোণঠাসা। ফলে তাদের এখন রাজ্যের ঠিক করা জেলাবিন্যাস মেনে নিতে হয়েছে। সরকারের একটি সূত্রের বক্তব্য, চাপের মুখে নিরাপত্তার প্রশ্নেও শেষ পর্যন্ত আপস করতে হতে পারে কমিশনকে। সে ক্ষেত্রে একটাই পন্থা। তা হল, স্পর্শকাতর বুথের সংখ্যা কমিয়ে দিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর চাহিদাটাই কমিয়ে দেওয়া।
কিন্তু কমিশন এই ধরনের পদক্ষেপ করতে নারাজ। কমিশন সূত্রে বলা হয়েছে, আইন-শৃঙ্খলার প্রশ্নে আপস করবে না তারা। স্পর্শকাতর বুথের সংখ্যা এখন কমিয়ে দেওয়ার কোনও অবকাশও নেই, কারণ এই তালিকা আদালতে পেশ করা হয়েছিল। সে সব খতিয়ে দেখেই রায় দিয়েছে ডিভিশন বেঞ্চ। ফলে এখন ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে ভোট শেষ করার দায় যেমন কমিশনের রয়েছে, তেমনই বাড়তি ৭৫ হাজার ফোর্স জোগাড়ের দায়িত্ব রাজ্যের। নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রাখতে গিয়ে ইতিমধ্যেই স্বরাষ্ট্রসচিব-ডিজিকে ডেকে কমিশন বলে দিয়েছে, কোথাও ভয় দেখিয়ে মনোনয়ন জমা দেওয়া আটকানো হয়েছে, এমন অভিযোগের প্রমাণ মিললে সেই এলাকার ভোটই বন্ধ করে দেওয়া হবে। এ ধরনের ৯টি অভিযোগ পেয়েছে কমিশন। সেগুলি খতিয়ে দেখার পাশাপাশি কমিশনার পরিস্থিতি যাচাইয়ে নিজেও জেলা সফরে বেরোবেন।
কমিশনের সচিব তাপস রায় এ দিন জানিয়েছেন, চলতি সপ্তাহের মধ্যেই তাঁরা পঞ্চায়েত নির্বাচনের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে দেবেন। তবে স্পর্শকাতর বুথ চিহ্নিতকরণ এবং কোথায় কত বাহিনী লাগবে, সে বিষয়ে তাঁরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। বিষয়টি চূড়ান্ত হলেই রাজ্যকে তাঁরা জানিয়ে দেবেন। তিনি এ দিন এ-ও জানিয়েছেন যে, অতি স্পর্শকাতর এবং স্পর্শকাতর বুথ চিহ্নিতকরণ নিয়ে কমিশনের সঙ্গে ডিএম-এসপিদের দেওয়া রিপোর্টের কোনও অমিল নেই। কারণ, জেলা থেকে একই রিপোর্ট কমিশন ও মহাকরণে এসেছে।
তবে এর পরেও কমিশন যে ভোট প্রক্রিয়া কার্যত চালু করে দিচ্ছে, তা বুঝিয়েছেন তাপসবাবু। আগামী শনিবার ২১০ জন পর্যবেক্ষককে নিয়ে শিশির মঞ্চে প্রশিক্ষণের কাজ শুরু হবে। এ দিন তাপসবাবু জানান, প্রথম দফায় ২১০টি ব্লকে ওই ২১০ জন পর্যবেক্ষক ভোটের দায়িত্ব সামলাবেন। তাঁদের নিয়োগপত্র পাঠানোর কাজ শুরু করে দিয়েছে কমিশন। ওই ২১০ জন পর্যবেক্ষকের মধ্যে ৪৪ জন আইএএস ছাড়াও ডব্লিউবিসিএস এবং ফরেস্ট সার্ভিস আধিকারিকরা রয়েছেন। রয়েছেন সহ-সচিবরাও।
|