ঠাকুরমা নাম দিয়েছিলেন মৃদুল। ওই নামেই সবাই বড় নাতিকে ডাকত। একটু জ্ঞানগম্যি হতেই বড় নাতির নিজেরই ওই নামটি পছন্দ হয়নি। তাই এক সকালবেলা, হয়তো সদ্য পড়া শ্রীকান্ত উপন্যাসের গুণেই, নিজেই নামটি বদলে রাখল ইন্দ্রনাথ, ‘শুনতে ভাল লাগবে ভেবে’। জেদ ধরল, একমাত্র ওই নামেই সে সাড়া দেবে। নিজের মতো করে ভাল লাগা বা না-লাগার খেয়ালি মেজাজটারই নাম ইন্দ্রনাথ মজুমদার, মেজাজটাই তিনি। কত কাজ তাঁর! ছাত্রাবাসের সুপারগিরি ও পুরনো বইয়ের জন্য গোয়েন্দাগিরি, ১৯৮৪ সাল থেকে একই সঙ্গে শান্তিনিকেতনের সাজানো পরিবেশে ও একদা হ্যারিসন রোডের ঘুপচি ঘরে ‘সুবর্ণরেখা’ নামে দোকানে বই কেনা, বেচা, পড়ানো ও ছাপানোর সংস্থা চালানো ওই ইন্দ্রনাথসুলভ মেজাজটাই এত কাজকারবারকে অনন্য করেছিল।
যশোরের লোক, রংপুরে পড়াশোনা, ইস্কুলের গণ্ডি আর পেরোনো হয়নি। বাবা কাজ করতেন ইছাপুরের গান-ফ্যাক্টরিতে, ১৯৪৭-এর পরে ওখানেই খামখেয়ালি ছেলেটা শম্ভুনাথ মল্লিকের জাতীয় ক্রীড়া ও শক্তি সংঘ-তে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে বনের মোষ তাড়াবার কাজে হাত পাকান। লোককে ডেকে বই পড়ানোর বাতিক ছিল। ফুটপাত থেকে পুরনো বই কিনে বাড়িতে পাড়ার ছেলেপুলের জন্য নিজস্ব লাইব্রেরি খুলেছিলেন, ইছাপুরে ‘অনুশীলন’ বলে এক সমিতির লাইব্রেরি তৈরি করেন। সেই সূত্রেই গত শতকের পঞ্চাশের দশকে গ্রন্থাগার আন্দোলনের কর্মী হিসেবে প্রবীর রায়চৌধুরীর সঙ্গে গ্রামে গ্রামে ঘুরেছেন, ‘গ্রন্থাগার’ পত্রিকায় ছোট প্রবন্ধ লিখেছেন, বাঁকুড়ায় একাদশ বঙ্গীয় গ্রন্থাগার সম্মেলনের অন্যতম উৎসাহী উদ্যোক্তাও ছিলেন। গ্রন্থাগারিকদের বৃত্তে তাঁর আনাগোনা ও গ্রামবাংলা, বিশেষত রাঢ় অঞ্চলে তাঁর ঘোরাফেরা তখনই শুরু হয়েছিল, অশক্ত হয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত তিনি অভ্যাসটা বজায় রেখেছিলেন। |
ইন্দ্রনাথ মজুমদার rolling stone. ১৯৬০-এ শম্ভুনাথের আমন্ত্রণে কলকাতার বিধান ছাত্রাবাসে লাইব্রেরিয়ান কাম সুপারের কাজ নিচ্ছেন। তোফা চাকরি, থাকা-খাওয়া সব ফ্রি, একশো টাকা মাইনে। নানা জেলার মেধাবী ছাত্ররাই আবাসিক, খাইখরচা তাদেরও লাগত না। নিয়ম মানতে ও মানাতে বড়ই সহৃদয় ছিলেন, আবাসিকদের সঙ্গে সমঝোতা গড়ে উঠতে অসুবিধে হয়নি। সে দিনের বোর্ডারদের মধ্যে কেউ কেউ পরে অধ্যাপক বা ভাইস চ্যান্সেলর, যেমন রাধারমণ চক্রবর্তী বা অলোক রায়। কেউ আবার নকশাল নেতা, যেমন সন্তোষ রাণা বা অসীম চট্টোপাধ্যায়। মতামত নির্বিশেষে সুপারের সপ্রশংস স্মৃতিচারণ সবাই করেছেন, পরের জীবনে যোগাযোগও হারাননি।
চেনাশোনার বৃত্ত বড় হতেই লাগল। পানের টানে খালাসিটোলায় নিয়মিত যেতেন, গুরুপ্রতিম কমলকুমার মজুমদারকে চেনেন সেখানেই। সেই সূত্রেই শক্তি, সুনীল আর বেলাল চৌধুরির সঙ্গে আড্ডা জমত। সবার পায়ের তলায় সরষে, যত্রতত্র ঘুরতে বাধা কী? এই রকম পথ চলার টানেই ইন্দ্রনাথের বিচিত্র সব বন্ধু হয়েছে। এই রকম বন্ধুভাগ্য খুব কম লোকেরই ছিল।
১৯৬০-এর মাঝামাঝি সময় থেকেই বিধান ছাত্রাবাস রাজনৈতিক আন্দোলনের চাপে উঠে গেল। বইয়ের টান তো আবাল্য রক্তে ছিল। ইন্দ্রনাথ শুরু করলেন পুরনো বইয়ের বেসাতি, মহাত্মা গাঁধী রোডের ভাঙাচোরা বাড়ির দোতলায় এঁদো পড়া ঘরে বাহারি এক নামওয়ালা দোকান ‘সুবর্ণরেখা’। কোনও অভিজ্ঞতা নেই, কারও কাছেই দীক্ষা নেননি, সবই করে আর ঠেকে হাবুল শেখে। বই ছুঁয়ে, গন্ধ শুঁকে, পাতা উল্টে, বইপোকাদের জেনে ইন্দ্রনাথ বই কিনতেন ও বেচতেন। অবন ঠাকুরের পুরনো বইয়ের সংগ্রহ থেকে হিন্দু স্কুলের হেডমাস্টারের বইয়ের ভাঁড়ার, বিহার আর উত্তরপ্রদেশের সরকারি গুদামঘর থেকে দামি-দামি সরকারি রিপোর্ট সুলুকসন্ধানী ইন্দ্রনাথ নিজেই ঠিক জায়গায় পৌঁছে যেতেন। ব্যবসা শুরু হয়েছিল ভারততত্ত্বের ভারী-ভারী বই বেচাকেনা করে, যেমন, ইয়াজদানির অজন্তা বা রাধাকান্ত দেবের শব্দকল্পদ্রুম। পরে চার দশক ধরে সমান আগ্রহেই জোগাড় করেন বটতলার চটি গোপাল ভাঁড়, সিনেমা হলের এক পয়সার প্যামফ্লেট বা সচিত্র ভোজবিদ্যা ও চিৎপুরের হলদে-হলদে যাত্রাপালা। বিচিত্র লোক বা নানা প্রতিষ্ঠানের বৌদ্ধিক ও সাংগ্রহিক আবদার মেটাতে তাঁর জুড়ি গোটা পশ্চিমবঙ্গে কেউ ছিল না। বিড়লা টেকনিকাল মিউজিয়ম খুঁজছে, তাই লাভপুরের এক দর্জির দোকান থেকে সংগ্রহ করে এনেছিলেন কেরোসিনে চলা এক টেবিলফ্যান। কোনও কিছুই তো ফেলনা নয়, সব তুচ্ছতেই ইতিহাসের পরশ আছে, খালি চেনার চোখ ও বোঝার মন থাকা চাই।
ইন্দ্রনাথ বই দেখতেন, বইতে কোনও-না-কোনও পাঠকের মুখ ভেসে উঠত, পাতা ও মুখ একাকার হয়ে যেত। সাবেকি বইকে অনেক হালফ্যাশনি পাঠক অবজ্ঞা করবে, হয়তো বা কেবল এক জনই ওই বইটার জন্যই হা-পিত্যেশ করে বসে আছে। সে কালের একটা বই এ কালের কোনও বিশেষ এক পাঠকের মনে কী অনুরণন তুলবে, সেই স্পন্দনের দুর্লভ নাড়িজ্ঞানটি ইন্দ্রনাথের ছিল। ঠিক ঠাহর করে ইন্দ্রনাথ সর্বোত্তম পাঠকের কাছে তার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বইটা পৌঁছে দিতেন। আরও অনেকে বইটার জন্য বেশি দাম দিতে চেয়েছে, ইন্দ্রনাথ একেবারে কান দেননি, অনেক কম দামে, সময় সময় বিনা দামেই যার সবচেয়ে দরকার তারই হাতে বিশেষ বই তুলে দিয়েছেন। দেবার সময় নিজে একগাল হেসেছেন, ওই হাসতে পারাটাই যেন তাঁর পরম প্রাপ্তি। নিজের পছন্দের বই লোককে পড়াতেন, চারুচন্দ্র দত্তের কৃষ্ণরাও পড়িনি বলে কী ধমক খেয়েছিলাম! পাক্কা বিশ বছর বাদে ধমকটা মনে করিয়ে বইটা আমায় তিনি উপহার দিয়েছিলেন।
এ হেন লোকের খরিদ্দারের তালিকা তো গত শতকের শেষ পর্বের বাঙালি সারস্বত সমাজের whos who. প্রয়াত সত্যেন্দ্রনাথ বসু, বিনয় ঘোষ, নিখিল সরকার থেকে এ কালের কলকাতা-বিশেষজ্ঞ দেবাশিস বসু। দোকানে বিদেশিদের ভিড় লেগেই থাকত, ব্লেয়ার ক্লিং ও ট্রেভর লিং থেকে অ্যান্ড্রু সাত্তোরি ও টোনি স্টুয়ার্ট। ইন্দ্রনাথ নির্বিকার ও নির্বিচার, দেশি বা বিদেশি, নবীন বা প্রবীণ, কোনও দিন ব্যবহারে কারওর মধ্যে তিনি ইতরবিশেষ করেননি।
সহকর্মী, পরে পরামর্শদাতা ও বন্ধু বিমান সিংহের সহযোগিতায় ইন্দ্রনাথ বইও ছাপাতেন। খুব বেশি দাবি ছিল না, ‘রুচিশীল ও সশ্রদ্ধ প্রকাশন’, এটাই ছিল তাঁদের উদ্দেশ্য। প্রকাশিত বইয়ের নাতিদীর্ঘ তালিকাটি ইন্দ্রনাথের ‘রমতা’ মনের সাক্ষ্য। ক্রিকেটের সংখ্যাতথ্য নিয়ে মতি নন্দীর ছোট ইংরেজি বই দিয়ে যাত্রা শুরু। প্রতি বছরই একটা বা দুটো বই বেরোত, সংখ্যায় কম, বিষয়ে চমকপ্রদ। তালিকায় কী নেই, গিরিশচন্দ্র বেদান্ততীর্থের প্রাচীন শিল্প পরিচয় থেকে রাধারমণ মিত্রের কলিকাতা দর্পণ। কমলকুমার মজুমদার সম্পাদিত ‘অঙ্ক ভাবনা’ পত্রিকার পাশাপাশিই শোভা পেত তাঁরই কাঠখোদাইয়ে চিত্রিত ছড়ার বই পানকৌড়ি, আর উপন্যাস পিঞ্জরে বসিয়া শুক, আজও লোকে খুঁজে বেড়ায়। বিনোদিনীর আমার জীবন ও অন্যান্য রচনা-র পাশেই উঁকি দিত ভিন্ন স্বাদের স্মৃতি, সোমনাথ হোরের তেভাগার ডায়েরি। মাঝে মাঝে ভারী পাষাণও চাপানো হত। কলকাতার উপর সৌম্যেন মুখোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ সংকলন আর সমর সেনকে দেওয়া প্রবন্ধ শ্রদ্ধার্ঘ্য, নাম Truth Unites.
বিষয়বৈচিত্র বা পুরনো বইয়ের ফ্যাকসিমিলি ছাপাতেই ইন্দ্রনাথ বা বিমানবাবুর আগ্রহ সীমাবদ্ধ ছিল না। বই তৈরি করতে তাঁরা জানতেন।হলদে পার্চমেন্ট সদৃশ কাগজে রামপ্রসাদী কবিতার দ্বিভাষিক সংস্করণ ছাপা হয়েছিল, নীরদ মজুমদারের তন্ত্রসুলভ গ্রন্থচিত্রণ-সহ। বাংলার কবিতা ও ধর্মসাধনার মেলবন্ধন দুই মলাটের মধ্যে যে রকম দৃশ্যগ্রাহ্য উপস্থাপনায় ধরা দিয়েছিল, সেটি আজও তুলনারহিত। অরুণ নাগ সম্পাদিত সটীক হুতোম প্যাঁচার নকশা-র সুবর্ণরেখা সংস্করণে প্রতি পাতায় মূল পাঠের সঙ্গে নানা স্তরে টীকা, শব্দার্থ ও প্রমাণসাজানো হয়েছিল, যেন ঠাসবুনোটের এক অন্য সূচিকর্ম। এই রকম একমেবাদ্বিতীয়ম্ প্রকাশন দুটির জন্য ইউ রায়, সিগনেট ও নাভানা-রসঙ্গেই ‘সুবর্ণরেখা’র নাম সমমর্যাদায় উচ্চারিত হওয়ার যোগ্য।
‘তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ।’ কলকাতার দোকানে বা শান্তিনিকেতনে সুবর্ণরেখার চত্বরে বিচিত্র সব লোকদের আড্ডা বসত। ফাঁকে ফাঁকে ইন্দ্রনাথ বলে মানুষটি বাদুড়ের মাংসের স্বাদ নিয়ে তাঁর নিজস্ব তত্ত্ব হাজির করতেন, আর বাজার থেকে পোকা বেগুন কেনবার উপদেশ দিতেন। পোকা আছে, অতএব প্রমাণ যে, বেগুনে ওষুধ দেওয়া হয়নি, অতএব ওই বেগুনই স্বাস্থ্যকর। কথার ফাঁকে নানা বৃত্তের যোগাযোগের টানেই কথকঠাকুরদের সাকিন তিনি গড়গড় করে বলে দিতেন বা অবলীলায় পুরনো সাইনবোর্ডের সংগ্রাহকের হদিশ বাতলাতেন, তা না হলে কী করেই বা ‘নন্দন’-এ জমকালো প্রদর্শনী করা সম্ভব হবে? এ হেন মানুষটা ২৫ বৈশাখ চলে গেলেন। জানি যে, ইন্দ্রনাথদের মতো মানুষকে পৃথিবী এক বারই পায়, আর দ্বিতীয়টি মেলে না। বই খুঁজতে গিয়ে, রেফারেন্স হাটকাতে হাটেগঞ্জের লোকের নাম জানতে প্রায়ই তাঁর কথা মনে পড়বে, ‘বড় miss করছি ইন্দ্রদা’। ইন্দ্রদা হাসবেন আর বলবেন, ‘দূর পাগল, ভরসা রাখো, অত্তদীপো ভব, অত্তসরণা, অনন্যসরণা বিহরম।’ |