যদি এক মহাপ্রলয়ে কোনও দিন ধ্বংস হয় সভ্যতা, হারিয়ে যায় যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত বিজ্ঞানের দান, তা হলে পরবর্তী প্রজন্মের সম্বলে কোন জ্ঞানটুকু টিকে থাকলেই চলবে? সবচেয়ে কম শব্দে সবচেয়ে বেশি তথ্য বহন করবে কোন বক্তব্য? একদা এ প্রশ্ন তুলেছিলেন জগদ্বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান। জবাবও দিয়েছিলেন নিজে। বলেছিলেন, মহার্ঘ সেই তথ্যটি হবে এ রকম: সব কিছু পরমাণু দিয়ে গড়া সেই কণা, যারা সর্বদা চলমান, স্বল্প দূরত্বে থাকলে যারা একে অন্যকে কাছে টানে, কিন্তু ঘাড়ে পড়লে আবার এ ওকে দূরে ঠেলে দেয়। সামান্য কল্পনা আর চিন্তাশক্তি প্রয়োগ করলেই ওই একটি মাত্র বাক্য হয়ে উঠতে পারে এই বিশ্ব সম্পর্কে প্রভূত জ্ঞানের আধার।
সত্যি, পদার্থের নিজস্ব গুণাগুণ-সংবলিত ক্ষুদ্রতম কণা যে তার পরমাণু, সে উপলব্ধি বিশ্ববিজ্ঞানের মূল কথা। ব্রহ্মাণ্ডের অপার রহস্য সমাধানে মানুষের প্রথম পদক্ষেপ ওই সোপানটিতে। কেন দু’টি পরমাণু স্বল্প দূরত্বে প্রেমাসক্ত, আর কেনই বা অতি নিকটে তাদের বৈরী, এ সব ধাঁধার সমাধানের গড়ে উঠেছে পদার্থবিদ্যার বিশাল ইমারত। এবং আধুনিক প্রযুক্তি। ইলেকট্রনিক্স থেকে অত্যাধুনিক চিকিৎসা পর্যন্ত সব কিছু।
যে জ্ঞানের গর্ভে সুপ্ত ছিল প্রযুক্তির এত বিপুল সম্ভাবনা, তার জন্ম ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে। অর্থাৎ, এ বছর শতবর্ষে পা দিল সেই সাফল্য। অথচ আশ্চর্য, তাকে স্মরণ বা সম্মান জানাতে কোনও আয়োজন নেই বিজ্ঞানের জগৎসভায়। এতখানি উপেক্ষা বোধহয় প্রাপ্য নয় ওই সাফল্য কিংবা তার জনকের। |
বিজ্ঞান, কারা যেন বলেছিলেন, এগিয়ে চলে এক শবযাত্রা থেকে আর এক শবযাত্রায়। এক তত্ত্ব বা ধারণার মৃত্যু ঘোষিত হয় নতুন তত্ত্ব বা ধারণার জন্মে। তার পর, মৃত্যু আসে তারও। যে কোনও পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা কী? পরমাণু। পরমাণু কেমন? তার একটা ধারণা দিলেন জোসেফ জন টমসন। ১৮৯৭ সালে তিনি খুঁজে পেলেন পরমাণুর মধ্যেকার কণা ইলেকট্রন। ইলেকট্রন নিস্তড়িৎ নয়, নেগেটিভ চার্জ-বিশিষ্ট। অথচ, গোটা পরমাণু জিনিসটা নিস্তড়িৎ। অতএব, ইলেকট্রনের নেগেটিভ চার্জকে প্রশমিত করার মতো কিছু একটা পরমাণুর মধ্যে নিশ্চয়ই লুকিয়ে আছে। এবং তা অবশ্যই পজিটিভ চার্জ-বিশিষ্ট। তা কি? সেটা স্পষ্ট জানাতে পারলেন না টমসন। শুধু অনুমানে পেশ করলেন পরমাণুর একটি ছবি। একটা গোলক, যার সবটা জুড়ে ঘন পদার্থ। ওটা পজিটিভ চার্জ-বিশিষ্ট। আর তার মধ্যে ইতস্তত ছড়ানো মিষ্টি দানার মতো নেগেটিভ চার্জ-বিশিষ্ট ইলেকট্রন।
এ মডেল ভেঙে খানখান ১৯১১ সালে। নিউজিল্যান্ডের বিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড এবং তাঁর সহকারীদের পরীক্ষার বিস্ময়কর ফলাফলে। তেজস্ক্রিয়তা (কিছু পদার্থ থেকে আপনাআপনি আলো বিচ্ছুরণ) আবিষ্কারে গবেষক মহলে তখন তুমুল সাড়া। দেখা গেছে পদার্থ থেকে যা যা বেরোচ্ছে, তার একটা হল দারুণ বেগবান পজিটিভ চার্জ-বিশিষ্ট রীতিমতো ভারী কণা। যার নাম দেওয়া হল ‘আলফা’। তো সেই আলফা কণাকে গুলতির মতো ব্যবহার করলেন রাদারফোর্ড এবং তাঁর সহকারীরা। কাগজের চেয়েও পাতলা সোনার পাত লক্ষ্য করে ছুড়লেন আলফা কণা। সোনার পাত মানে সারি সারি সোনার পরমাণু। টমসনের অনুমান অনুযায়ী যে সবের মধ্যে ছড়ানো পজিটিভ চার্জ আর এখানে-ওখানে দু-একটা নেগেটিভ চার্জ-বিশিষ্ট ইলেকট্রন। এ রকম জিনিস লক্ষ্য করে আলফা কণা ছুড়লে কী হবে, তা অনুমান করা সহজ।
পরীক্ষার ফল কিন্তু অনুমানকে ছাপিয়ে গেল ভীষণ ভাবে। বেশ কিছু আলফা কণা সরাসরি সোনার পাত ভেদ করল, সামান্য কণার পথ একটু-আধটু বাঁক নিল, আর অনেক কণা সোনার পরমাণুর মধ্যে উপস্থিত কোনও কিছুতে এত জোর ধাক্কা খেল যে, প্রায় ফিরে এল উল্টো পথে। হতচকিত রাদারফোর্ড মন্তব্য করলেন, ‘আমার জীবনে সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা। এতটাই অবিশ্বাস্য যে, ধরুন আপনি ১৫ ইঞ্চি ব্যাসের গোলা ছুড়লেন টিস্যু পেপার লক্ষ করে, আর তার পর সে গোলা ফেরত এসে আঘাত করল আপনাকে!’
আলফা কণাকে গুলতি বানিয়ে সোনার পাতে আঘাতের ফলাফল বলে দিল, পরমাণুর ভিতরে ইলেকট্রন আর অনেকটা ফাঁকা জায়গা ছাড়াও রয়েছে একটা গাঁট। তা বেশ ভারী এবং পজিটিভ চার্জ-বিশিষ্ট। তাই ফাঁকা জায়গা ভেদ করে বহু আলফা কণা বেরিয়ে গেলেও, কিংবা কিছু কণা ইলেকট্রনে ঠোক্কর খেয়ে পথ একটু বদলালেও, বেশ কিছু আবার ওই ভারী গাঁটে জব্বর ধাক্কা খেয়ে প্রায় উল্টো দিকে ফেরত আসছে। আলফা নিজে কিছুটা ভারী এবং পজিটিভ চার্জ-বিশিষ্ট না-হলে ধাক্কাটা অত জব্বর হত না।
রাদারফোর্ড এবং তাঁর সহকারীরা ওই পরীক্ষার ফলাফল দেখে পেশ করলেন পরমাণুর নতুন মডেল। বললেন, পরমাণুর মধ্যে পজিটিভ চার্জ কুয়াশার মতো সবটা জায়গা জুড়ে ছড়ানো নয়, মাঝখানে কোনও একটা জায়গায় পুঞ্জীভূত। সেই জায়গাটা আবার ভারীও বটে। ইলেকট্রনের ওজন তো নগণ্য, পরমাণুর ওজনের সবটাই যেন প্রায় ওইগাঁটের ওজন। ভারী ওই কেন্দ্র ঘিরেঘুরপাক খাচ্ছে ইলেকট্রনেরা। ঠিক যে ভাবে সৌরমণ্ডলে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে বুধ শুক্র পৃথিবী ইত্যাদি।
সর্ষের মধ্যে ভূতের মতো ও-রকম কল্পনার মধ্যেই যে গলদ। সৌরমণ্ডল আর পরমাণু এক নয়। গ্রহগুলোর চার্জ নেই, ইলেকট্রনের তা আছে। ঘুরতে ঘুরতে গ্রহেরা এনার্জি হারাচ্ছে খুব কম। অন্য দিকে, চার্জবিশিষ্ট ইলেকট্রনেরা বিজ্ঞানের নিয়মে এনার্জি হারাচ্ছে দ্রুত। ঘূর্ণায়মাণ ইলেকট্রনের সব এনার্জি ১ সেকেন্ডের ১০০,০০০,০০০,০০০ ভাগের এক ভাগ সময়ে ফুরিয়ে যাওয়ার কথা। ফলে, চরকিবাজি বন্ধ করে তা মুখ থুবড়ে পরমাণুর কেন্দ্রে ওই ভারী জায়গাটায় গিয়ে পড়তে বাধ্য। তা হলে আর পরমাণুর অস্তিত্ব থাকে কোথায়? অথচ, বাস্তবে তো পরমাণু জ্বলজ্বল করছে। তার অস্তিত্ব তো অটুট।
পরমাণুর গঠন সম্পর্কে কল্পনা আর বাস্তবের বিবাদভঞ্জন করলেন এক গবেষক। সাতাশ বছর বয়েসে ডেনমার্ক থেকে যিনি ইংলন্ডে এসেছেন রিসার্চের আশায়। এই নিল্স বোর মনে মনে গুরু মানেন টমসনকে। তাঁকে বললেন পরমাণু সম্পর্কে নতুন ভাবনার কথা। প্রবীণ টমসন পাত্তা দিলেন না নবীন গবেষকটিকে। অগত্যা বোর শরণাপন্ন রাদারফোর্ডের।
নতুন আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে উপনীত এক জন বিজ্ঞানীর মনের অবস্থা কেমন? সংশয় আর আত্মবিশ্বাসের সে এক বিচিত্র দোলাচল। প্রমাণ এই চিঠিখানি। ইংলন্ড থেকে ডেনমার্কে ভাইকে বোর লিখলেন, ‘হয়তো পরমাণুর গঠনের কিছুটা আমি বুঝে ফেলেছি। কাউকে এখনই কিচ্ছু বোলো না, নয়তো এত তাড়াতাড়ি আমি তোমায় জানাতাম না। আমি যদি ঠিক বুঝে থাকি, তবে যা জেনেছি তা সম্ভাবনার ব্যাপার নয়, বাস্তবের ব্যাপার। ভেবে দেখো আমি ভুলও হতে পারি, এখনও তো সব কাজ সারা হয়নি (অবশ্য আমার তা মনে হয় না)।
অবশেষে ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত জার্নাল ‘ফিলোজফিকাল ম্যাগাজিন’-এ তিন কিস্তির পেপার। প্রতিপাদ্য যার বৈপ্লবিক। অবিশ্বাস্যও বটে। বোর বললেন, পরমাণুর মধ্যে ইলেকট্রনগুলো ইচ্ছে মতন কক্ষপথে ঘুরতে পারে না। তাদের এক-একটার চলার পথ নির্দিষ্ট। ওই নির্দিষ্ট কক্ষে আবহমান কাল ঘুরলেও একটা ইলেকট্রনের এনার্জি বাড়ে বা কমে না। তা বাড়ে-কমে যখন সেটা এক কক্ষপথ থেকে অন্য কক্ষপথে যায়। এই পথবদলও আবার কিম্ভূত। কোনও ইলেকট্রন এক পথ থেকে অন্য পথে যায় মাঝের জায়গাটা পাড়ি না দিয়েই। এক পথ থেকে হাপিশ, অন্য পথে সেই মুহূর্তেই হাজির! ম্যাজিক!
এই যে ইলেকট্রনগুলোর কক্ষপথ নির্দিষ্ট, দুটো পথের মাঝখানে আর কোনও পথের অস্তিত্ব নেই, এ ব্যাপারটা বিজ্ঞানী জর্জ গ্যামো ব্যাখ্যা করেছেন চমৎকার উদাহরণে। বলেছেন, গাড়ি যেমন গিয়ার-১ বা গিয়ার-২-এ চলে, দেড় গিয়ারে চলতে পারে না কখনও, ইলেকট্রনের কাজ-কারবারও তেমন। নিজের কক্ষপথে যতই ছুটুক ইলেকট্রন, তার এনার্জির ক্ষয় নেই। ফলে গতি হারিয়ে তার পরমাণুর মাঝখানে পজিটিভ চার্জবিশিষ্ট গাঁটে মুখ থুবড়ে পড়ারও সুযোগ নেই। এ কারণে পরমাণু অটুট, স্থায়ী। ‘ফিল ম্যাগ’-এ পরমাণুর গঠন ব্যাখ্যায় বোর-এর পেপার পড়ে অকপট স্বীকারোক্তি এক জনের। আলবার্ট আইনস্টাইন। তিনি বললেন, ‘অনেকটা এ রকম ভেবেছিলাম আমিও। সাহস করে এগোতে পারিনি।’
১৯১৩ সালে ‘ফিল ম্যাগ’-এ সেই তিনটে পেপারের পর পরমাণু সম্পর্কে ধারণা এগিয়েছে অনেক দূর। বস্তুত, ভুলও ধরা পড়েছে বোর-প্রস্তাবিত পরমাণুর গঠনের। তা হোক, তবু ওই সব ভুল শোধরাতে গিয়েই কিন্তু গড়ে উঠেছে নতুন বিদ্যা। কোয়ান্টাম মেকানিকস। যার সূত্রে ইলেকট্রনিক্স প্রযুক্তি। সে এক বিপ্লব। যার শেষ কোথায়, কেউ জানে না। যে বস্তুটার মাপ ১ মিলিমিটারের ১০,০০০,০০০ ভাগের এক ভাগ, সেই পরমাণুর অন্দরমহলের রহস্য উদ্ঘাটন করতে করতে এগিয়ে চলেছে সভ্যতা। অগ্রগতির ভগীরথ নিল্স বোর-কে ভুলে যাওয়া পাপ। |