বলিলে ঈষৎ মাত্র অত্যুক্তি হইবে, আফগানিস্তান আছে তালিবানেই। বিশেষত, মহিলাদের অধিকারের প্রশ্নে। সম্প্রতি এক প্রেসিডেন্ট-স্বাক্ষরিত হুকুমনামাকে সংসদীয় ভোট মারফত আইনে পরিণত করার প্রয়াস রক্ষণশীল সাংসদদের বাধায় বানচাল হইয়া গিয়াছে। মহিলাদের বিরুদ্ধে হিংসা নির্মূল করার জন্য প্রস্তাবিত আইনটিতে শিশুকন্যার বিবাহ, পরিবার বা গোষ্ঠীর বিবাদ-মীমাংসায় মহিলাদের ‘বিনিময়’ করা ও মেয়েদের বিরুদ্ধে পারিবারিক হিংসাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ গণ্য করার এবং ধর্ষিতা মহিলাদের ‘ব্যভিচারী’ হিসাবে বিচার না-করার বিধান ছিল। সাংসদরা ইহাকে ‘ইসলাম-বিরোধী’ আখ্যা দিয়া সংসদে আলোচনাই করিতে দেন নাই। ধর্মীয় মৌলবাদ কেন মূলত বিপজ্জনক, এই আপত্তি তাহার উৎকট প্রমাণ। মৌলবাদ প্রশ্ন তুলিতে দেয় না, বিচার করিতে দেয় না, ফলে তাহার রাজত্বে সমস্ত অন্যায় অনাচার বহন করিয়া চলা ভিন্ন দ্বিতীয় কোনও উপায় নাই।
লক্ষণীয়, আফগানিস্তানে ৬২ জন মহিলা সাংসদের অধিকাংশই নারীর সমানাধিকারে বিশ্বাসী নহেন, অথবা ভয়ে মুখ ফুটিয়া নিজেদের অধিকারের কথা উচ্চারণ করিতে দ্বিধাগ্রস্ত। অন্যান্য পরিসংখ্যানও একই ইঙ্গিত করে। যথা, রাষ্ট্রপুঞ্জের একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়াছে, এই দেশে মহিলাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের মাত্র সাত শতাংশ আদালতের সম্মুখে পেশ হইয়া থাকে। একাধিক আফগান সাংসদ মনে করেন, মেয়েদের বাল্যবিবাহ একটি ধর্মবিহিত প্রথা। অবাধ্য স্ত্রীকে প্রহারও নাকি ধর্মগ্রন্থে অনুমোদিত, বস্তুত তাহা স্বামীর কর্তব্যও বটে! একই ভাবে ধর্ষণজনিত ব্যভিচারও একটি অপরাধ ধর্ষণকারীর তত নয়, যতটা ধর্ষিতার! প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, যে-নারী বলপূর্বক ধর্ষিতা, তাহাকে কেন ব্যভিচারী গণ্য করা হইবে? প্রতি‘যুক্তি’ অমোঘ: অন্যথা মেয়েরা অবাধে বিবাহবহির্ভূত যৌনতায় লিপ্ত হইবে, ধরা পড়িলে ‘ধর্ষিত’ হওয়ার দাবি জানাইয়া অব্যাহতি চাহিবে, যাহা সমাজে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করিবে। এমন ধারণায় আবিষ্ট সমাজের উত্তরণ, স্পষ্টতই, দূর অস্ত্। নারীর সমস্ত স্বাধীনতা হরণে যূথবদ্ধ পৌরুষই এই রাষ্ট্রের চালকদের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশের অভিজ্ঞান। কাবুলের শাসনক্ষমতা হইতে তালিবানের নির্বাসন, মার্কিন ও বহুজাতিক নেটো বাহিনীর উপস্থিতি এবং তাহার ছায়ায় প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের ‘নির্বাচিত সরকার’-এর শাসন এই রাষ্ট্রের মানসিকতাকে পাল্টাইতে পারে নাই। তাহার যাবতীয় রক্ষণশীল কুপ্রথা, মধ্যযুগীয় ধর্মীয় বর্বরতা অটুট রহিয়াছে। আশঙ্কা হয়, তালিবান প্রচারিত কট্টরপন্থী ধর্মান্ধতাই আফগানিস্তানের সামাজিক নিয়তি, মার্কিন ও বহুজাতিক বাহিনীর বিদায় তালিবানি বর্বরতার পুনরুজ্জীবনেই চিহ্নিত হইবে। আফগানিস্তানের অর্ধেক মানুষ কেবল ‘মানুষী’ হওয়ার অপরাধে ন্যূনতম মানবাধিকার হইতে বঞ্চিতই থাকিয়া যাইবে। রুশ-উত্তর পর্বের অভিজ্ঞতাই মার্কিন-উত্তর পর্বে পুনরাবৃত্ত হইবে। |