এমনকী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও নিশ্চয়ই মানিবেন যে, একটি সরকারের পক্ষে চার বছর খুব কম সময় নয়। কেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউ পি এ সরকারকে আর এক বছরের মধ্যে বিদায় লইতে হইবে, শাসক জোটকে নূতন করিয়া নির্বাচকমণ্ডলীর সম্মুখীন হইতে হইবে, স্বভাবতই এই চার বছরের কাজ ও অকাজের একটা খতিয়ান জনসাধারণ চাহিতেই পারেন। বিরোধীরা এই প্রসঙ্গ উঠিলেই নির্ঘাত বলিবেন যে, দুর্নীতি ও আর্থিক কেলেংকারি ছাড়া দ্বিতীয় ইউ পি এ দেশবাসীকে আর বিশেষ কিছুই উপহার দেয় নাই। কথাটি নিছক বিরোধী রাজনীতির অপপ্রচার বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া কঠিন। দিল্লির শাসকদের উপর দুর্নীতির ছায়া, বস্তুত, অতিকায়। তাহার মূল কারণ, সরকারের অকর্মণ্যতা, যাহা আবার রাজনৈতিক কর্তৃত্বের অভাব হইতেই সৃষ্ট। জোটের উপর প্রধান শরিক কংগ্রেস দলের এবং কংগ্রেস দলের উপর প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণের অভাব সরকারকে দিশাহীন, শিথিল এবং অক্ষম একটি যন্ত্রে পরিণত করিয়াছে, যাহার ফলে কোনও নীতিগত বিষয়েই কঠোর বা দৃঢ় সিদ্ধান্ত লইতে সরকার দ্বিধায় পড়িয়া গিয়াছে। ইহাতে কেবল আর্থিক সংস্কারের অসমাপ্ত এজেন্ডাই যে রূপায়ণের অপেক্ষায় পড়িয়া থাকে, তাহা নয়, ইউ পি এ-র ঘোষিত নীতিগত কর্মসূচির রূপায়ণও স্তব্ধপ্রায়। যাহাকে শাসকের নৈতিক অধিকার বলা হয়, মনমোহন সিংহের ভাণ্ডারে তাহা কতটুকু পড়িয়া আছে, তাহা এক কঠিন প্রশ্ন।
সংসদে ইউ পি এ-র গরিষ্ঠতা রীতিমত হ্রাস পাওয়া এবং জোট-বহির্ভূত ‘অনির্ভরযোগ্য’ দলগুলির সমর্থনে সরকার চালানো এই কর্তৃত্বহীনতার অন্যতম কারণ। তৃণমূল কংগ্রেস, ডি এম কে, মজলিস-এ-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন, তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি, ঝাড়খণ্ড বিকাশ মোর্চা ইত্যাদি ছয়টি শরিক কালক্রমে ইউ পি এ ছাড়িয়া দেওয়ায় সংসদে তাহার ওজন যথেষ্টই কমিয়া যায়। এই সুযোগে বিরোধী দল বিজেপি সংসদের ভিতরে বিল পেশ, তাহা লইয়া আলোচনা ও আইন প্রণয়নের সরকারি কাজটি কার্যত অসম্ভব করিয়া তোলে। একের পর এক অধিবেশন নিষ্ফল চলিয়া যায়। বহু ক্ষেত্রে সরকার পক্ষের অনমনীয় জেদ এ ব্যাপারে বিরোধীদের সুবিধাও করিয়া দেয়। উপরন্তু স্পেকট্রাম বণ্টন, কমনওয়েল্থ ক্রীড়া, কয়লার ব্লক বণ্টন, রেলের চাকরি ইত্যাদি নানা উপলক্ষে বিভিন্ন কেলেংকারির অভিযোগে বিপর্যস্ত সরকার এক দিকে বিরোধী পক্ষ, অন্য দিকে সুপ্রিম কোর্ট, সি এ জি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানেরর তীব্র সমালোচনার মুখে হালভাঙা নাবিকের মতো দিশাহীনতায় ভুগিতে থাকে। বিরোধীদের চাপে আইনমন্ত্রী ও রেলমন্ত্রীর ইস্তফার মতো প্রতিটি প্রশ্নেই সরকারের দুর্নীতিপরায়ণতা এবং চাপের কাছে নতিস্বীকারের প্রবণতা তাহাকে জেরবার করিয়া তোলে। অবস্থা এমনই যে, সরকারের নিত্যকর্মগুলিও সংশয় ও অনিশ্চয়তার মুখে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। দেশে আদৌ কোনও সরকার আছে কি না, তাহাই প্রশ্ন। প্রধানমন্ত্রী এই পরিণতির দায় এড়াইতে পারেন না। তাঁহার মাথার উপরে দলনেত্রী বসিয়া আছেন কি না, তাঁহার চতুষ্পার্শ্বে দলের বিবিধ স্বার্থগোষ্ঠী ঘুরিয়া বেড়াইতেছে কি না, তাঁহার সরকারের রশি নানা দিক হইতে নানা শরিক দল টানিয়া ধরিতেছে কি না, সে সকলই তাঁহার সমস্যা এবং তাঁহারই সমস্যা। দেশের নাগরিকরা জানেন, সরকার তাঁহার। তাঁহাকেই সরকার চালাইতে হইবে, না পারিলে সরিয়া যাইতে হইবে। নেতৃত্ব অধিকার দেয়, একই সঙ্গে সেই অধিকার সদ্ব্যবহারের দায়িত্ব দেয়। সে জন্য নেতাকে প্রয়োজনে কঠোর হইতে হয়, নির্মম হইতে হয়। প্রয়োজনে অত্যন্ত অপ্রিয় সিদ্ধান্ত লইতে হয়। চাপে পড়িলে, দেওয়ালে পিঠ ঠেকিলে তবে কঠোর সিদ্ধান্ত লইব, তবে অভিযুক্ত মন্ত্রীদের পদত্যাগ করিতে বলিব ইহা নেতৃত্বের লক্ষণ নহে। নেতৃত্ব দানের অর্থ স্বতশ্চালিত তৎপরতা। এখানেই প্রথম ইউ পি এ জমানার প্রধানমন্ত্রী সফল হইয়াছিলেন ভারত-মার্কিন প্রযুক্তি সংক্রান্ত চুক্তি স্মরণীয়। এখানেই দ্বিতীয় ইউ পি এ জমানার প্রধানমন্ত্রী ব্যর্থ হইয়াছেন। দুই প্রধানমন্ত্রীরই নাম মনমোহন সিংহ। কিন্তু নামে কী আসে যায়? |