|
|
|
|
হুল্লোড় |
সুর ভুলে গেলে অর্জুনকে ফোন করি
রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে অর্জুন চক্রবর্তী— বিস্ফোরক স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত।
মুখোমুখি স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায় |
|
স্বাগতালক্ষ্মী মানেই কপালে লম্বা টিপ। গান গাওয়ার সঙ্গে টিপ পরার কী সম্পর্ক?
(খুব হেসে) আসলে আমি মন্দিরের মানুষ। কপালের এই টিপে সবাই বলে আমায় নাকি খুব মানায়। আমি কিন্তু কোনও দিন বিউটি পার্লারে যাইনি। আর এই যে তিনটে সিঁদুরের লম্বা আঁচড় টানি, তার একটিতে সিদ্ধি বিনায়ক মানে মুম্বই, অপরটিতে তিরুপতি মানে দক্ষিণ ভারত আর দক্ষিণেশ্বর- এই তিনটে অঞ্চল নিয়ে বা বলতে পারেন পুরো ভারতবর্ষকে কপালে নিয়ে চলি।
রবীন্দ্রনাথও আপনার ঠাকুর আবার কালীও— এটা কী করে সম্ভব?
ঠাকুর কারণ তাঁর সঙ্গে আমার দূরত্ব আছে, তিনি আমার প্রাণের ঠাকুর। তার চেয়েও এখন মনে হয় আমার দ্বিতীয় বাবা। আগে বাবা খাওয়াতেন, এখন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর জন্যেই এত ভাল আছি, সবাইকে ভাল রাখছি। তবে আমার ঘরে বুদ্ধ, কোরান, মেরি মাতা, যিশু, সবাই আছেন। সাকার, আকার আর নিরাকার এই তিনটেই আমার ভেতরে ঢুকে গিয়েছে। দুর্গা বা কালীপুজো করে এসে যখন গান গাইছি, তখন চোখ বুজে নিরাকার কোনও শক্তিকে দেখছি। তিনিই তখন রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্ম। আমি আমার ছাত্রীদের তো বলি ঈশ্বর হল কম্পিউটার। আমরা আমাদের সুবিধা মতো তাঁকে বিভিন্ন আকার, নিরাকার বা সাকারে গড়ে তুলি। আমি এই তিনটেকেই বয়ে বেড়াই।
আনন্দplus-এ ৮ মে-র সংখ্যায় রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা রবীন্দ্রনাথের গানকে ইচ্ছেমতো গাওয়া যায় না বলে মন্তব্য করেছিলেন। এই গান নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হলে আপনি কি আপত্তি করতেন?
ওই সাক্ষাৎকারের কথা আমি জানি। প্রচুর ফোনও পেয়েছি আমি। তবে এখন যা বলব তা এক ধরনের অধিকারবোধ থেকেই বলব। আমার জীবনের একটা বড় অংশে আমি কেবল রবীন্দ্রনাথের গান নিয়েই পড়াশোনা করেছি। ২০০৬য়ে দু’হাজার গান নিয়ে একলা গীতবিতান করার অভিজ্ঞতাও আমায় রবীন্দ্রনাথকে নতুন ভাবে চিনিয়েছে। এই গান-চর্চাই আমার মধ্যে এক ধরনের অধিকার বোধের জন্ম দিয়েছে। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমি বলতে পারি ইদানীং রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে যে ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে তার অধিকাংশই রবীন্দ্রনাথকে না জেনে করা। রবীন্দ্রনাথের গানের একটা অদ্ভুত আকর্ষণ আছে, যিনি জানেন এবং যিনি জানেন না, তাঁদের সকলেরই ইচ্ছে করে তাঁকে নিয়ে কিছু করতে। এটার মধ্যে যেমন এক ধরনের সাফল্য আছে তেমনি একটা ভীষণ খারাপ দিকও আছে। খারাপ দিকটি হল অজ্ঞতা। এই অজ্ঞতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথকে ছুঁতে গিয়ে এখন তাঁর দাড়ি ছিড়ে নেওয়ার উপক্রম! আমি বলব এই বৃথা চেষ্টা থাকুক। পাশাপাশি দু’টোই চলুক। সাদা কালো পাশাপাশি চললে কালো ব্যাকগ্রাউন্ডে কিন্তু সাদাটাই উজ্জ্বল হবে।
সোমলতার গান শুনেছেন?
না শুনিনি, তবে সোমলতা বড় কথা নয়। সোমলতার আগেও অনেক রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা আমার কানে এসেছে। যাঁরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং রবীন্দ্রনাথ নিয়ে মতামত ছড়িয়ে বেড়াচ্ছেন, তাঁদের অনুরোধ করছি একবার মিউজিক ওয়ার্ল্ডে গিয়ে কোন শিল্পীর সিডি কত বিক্রি হয় সেটার খোঁজ রাখতে। আজও কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র বেস্ট সেলার। নিজের গানের চাহিদার কথা কোনও দিনই নিজ মুখে বলতে শিখিনি। তবে রবীন্দ্রনাথ থেকে অন্য ভাষার গান, গজল, ভক্তিগীতি সব মিলিয়ে আমার রেকর্ড করা গানের সংখ্যা এখন পাঁচ হাজার। গানের মধ্যে ডুবে থেকে, এত দিনের চর্চার পরে রবীন্দ্রনাথের গানে যা খুশি করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছি। |
|
যা খুশি মানে? নিজের মতো করে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া যাবে না?
কথা, সুর ঠিক রেখে বদল নিশ্চয়ই করা যায়। ধরো, তাসের দেশ-এ ‘চিঁড়েতন হরতন ইস্কাবন’ গানটি। এই গানে ছন্দের কথা মাথায় রাখলে জ্যাজ ব্যবহার করা যেতেই পারে, বা ‘মীনাক্ষীমেমুদম’ গানটি, যে গান ভেঙে রবীন্দ্রনাথ ‘বাসন্তী হে ভুবনমোহিনী’ লিখেছিলেন, সেখানে এস্রাজ ব্যবহার না করে বীণা বাজানো যেতেই পারে। কিন্তু ‘বাসন্তী হে ভুবনমোহিনী’-তে যদি জ্যাজ বাজে সেটাই ভয়ঙ্কর হবে। এটাই অল্প জানার ফল। কেউ যদি বিদেশি গানের সুরের আদলে রচিত রবীন্দ্রনাথের গান গিটার বাজিয়ে কোনও পাবে গান, তা হলে তো কিছু বলার থাকে না। সেটা তো নিজের মতো করেই গাওয়া হল।
রাবীন্দ্রিকতা বলে কিছু নেই?
নাহ্। রাবীন্দ্রিকতা বলে কিন্তু কিছু নেই। রবীন্দ্রনাথ নিজেই সেটা আমাদের জানিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। ওঁর গানেই একমাত্র কীর্তন থেকে কান্ট্রি মিউজিক— এত রকমের ধারা আছে। কিছু তো আর বাদ রাখেননি। সেই জন্যে ওঁর গানকে কেবল একটা ফর্ম বা রাবীন্দ্রিক ভাবলে চলবে না। রবীন্দ্রনাথ বার বার বলেছেন আমার গান যাতে আমার বলে মনে হয় সেইটা তোমরা কোরো। রবীন্দ্রনাথের এই বোধ, রবীন্দ্রনাথের ঘরানা, এগুলো মাথায় রেখেই কিন্তু গান শিখতে হবে, গাইতে হবে।
রবীন্দ্রনাথের গানে ঘরানা থাকার কী দরকার?
কেন? শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে ঘরানা নেই? কেউ কিরানা ঘরানা, কেউ বিষ্ণুপুর, আমি যেমন লখনউ ঘরানার। আলাদা আলাদা ঘর থেকে এক এক রকমের গায়কি, শিক্ষা বেরিয়ে আসবে, এটাই তো স্বাভাবিক। আমি নিশ্চিত আজ দক্ষিণী, গীতবিতান বা আমার ছাত্রছাত্রীরা কখনওই কেবল সোমলতার গান দিয়ে রবীন্দ্রনাথের গানকে চিনতে শিখবে না। আসলে শিক্ষার একটা বাঁধন থাকে। বাঁধন থাকাটা জরুরি।
যেমন বিশ্বভারতী বেঁধে দিয়েছিল?
বিশ্বভারতীর বাঁধনটা বড় শক্ত ছিল। আমি ঠিক প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা দিয়ে গান নিয়ন্ত্রণের কথা বলছি না। আমার একটা স্বপ্ন আছে জানো? জানি না তা আদৌ হবে কি না! আমি আজ আমজনতার কাছে, রবীন্দ্রগান-পাগল মানুষের কাছে, সরকারের কাছে আবেদন করছি আমাদের যে শিক্ষক, শিক্ষিকা, অগ্রজ শিল্পীরা আছেন— যেমন পূর্বা দাম, স্বপ্না ঘোষাল, পূরবী মুখোপাধ্যায়, চিত্রলেখা চৌধুরী, প্রমিতা মল্লিক, এঁদের নিয়ে একটা বোর্ড তৈরি হোক। তাঁরাই ঠিক করবেন রবীন্দ্রনাথের গান ইচ্ছেমতো গাওয়া যাবে কি না। বিশ্বভারতীর তো দরকার নেই।
‘চন্দ্রবিন্দু’র অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার সোমলতার গাওয়া ‘মায়াবনবিহারিণী’ গানটি নিয়ে বিরোধিতা প্রসঙ্গে বলেছেন উনি সোমলতার পক্ষে। ওঁর সাফ কথা, রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে অবশ্যই পরীক্ষা-নিরীক্ষা হবে, না হলে রবীন্দ্রসঙ্গীত টিকবে না।
আমি এটা একদমই মনে করি না যে রবীন্দ্রনাথের গানকে টিকিয়ে রাখার জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যেতে হবে। আচ্ছা বলো তো, আমি হট করে ইমন রাগ গাইতে গিয়ে যদি কড়ি মধ্যমের জায়গায় শুদ্ধ মধ্যম লাগাই, রাশিদ খান, অজয় চক্রবর্তী কি আমায় ছেড়ে দেবেন? তবে? রবীন্দ্রনাথের গানের ক্ষেত্রেই বা কেন ছেড়ে দেওয়া হবে? আর যাঁরা এ ধরনের পরীক্ষার কথা বলছেন, তাঁদের কাছে আমার অনুরোধ আপনারা দয়া করে জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে পরীক্ষা চালান না... দেখবেন সেটা তাঁরা কখনওই করবেন না কারণ সেখানে আইনের বাধা আছে। আমি চাই রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়ার ক্ষেত্রেও আইন আসুক। আসলে মুশকিল কী জানেন, রবীন্দ্রনাথ অনেক বেশি আপন হয়ে গিয়েছেন আমাদের। খুব বেশি কাছে আসাও কিন্তু ভাল না।
আপনার এমন হয়েছে কেউ বেশি কাছে এসে দূরে চলে গিয়েছেন?
আমি আমার জীবন দিয়ে দেখেছি, এ রকমটাই হয়। ধরুন কেউ প্রথম ফোন করল, বলল স্বাগতাদি আপনার সঙ্গে কথা বলছি, ভাবতেই পারছি না। তার পর সে কাছে এল। আবার হঠাৎ কখন যে সে চলে গেল, বলেও গেল না। আর বাইরের লোককে বলতে থাকল স্বাগতালক্ষ্মী বদমেজাজি, দাম্ভিক। ওর থেকে দূরে থাকাই ভাল।
খুব ভুল বোঝে বুঝি সবাই আপনাকে?
এটা খুব হয়। আমার শত্রু অনেক, কারণ আমি সত্যি কথা সোজা ভাবে বলি। তাতে আমার লাভ না ক্ষতি হল সেটা নিয়ে কখনও ভাবি না। সেই জন্যেই লোকে আমায় ভুল বোঝে। আমার পিআর-ও খুব খারাপ। তবে পিআর করে এক নম্বর হওয়াও যায় না।
মন খারাপ হয় ভুল বোঝাবুঝি হলে?
তা একটু হয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মতো আমারও তো তুলারাশি। খুব ব্যালান্স করে চলতে পারি আমি। আমি চেষ্টা করি আমার সহ্যক্ষমতা বাড়িয়ে চলার। আর কাজের মধ্যে, গানের মধ্যে ডুবে গিয়ে সেই খারাপ লাগা ভুলে থাকি। খুব দুঃখ পেলাম তো অনেক গান রেকর্ড করে ফেললাম, কবিতা নিয়ে বসলাম, ছবি আঁকলাম। একলা গীতবিতান করার সময় এমনটাই হয়েছিল। আমার প্রিয় বান্ধবী আমায় ছেড়ে চলে গিয়েছিল। কোনও এক টিভি চ্যানেলকে এও বলতে শুনেছি যে স্বাগতালক্ষ্মী দাবি করছেন উনিই নাকি একলা গীতবিতানের সমস্ত গান গেয়েছেন! আঘাত আমায় সৃষ্টি করতে শেখায়।
আপনার জীবনে প্রেম এসেছে?
(একটু ভেবে) প্রেম তো করাই হয়নি আমার। আমি ছোটবেলা থেকেই প্রেম করিয়ে দিয়ে চলেছি। স্কুলে আমি পিওন হিসেবে পরিচিত ছিলাম। চিঠি দেওয়া-নেওয়া করতাম। প্রেম ভাঙলে সাহায্য করেছি জুড়তে। ভাল দু’একজনকে লেগেছে। কিন্তু দূর থেকে দেখতেই চেয়েছি বরাবর।
অর্জুন চক্রবর্তীকে ছাত্র হিসেবে পেতে কেমন লেগেছিল?
সাংঘাতিক অভিজ্ঞতা। এখানেও রবীন্দ্রনাথের কথা আনি। রবীন্দ্রনাথ বলতেন এমনি দেখে যার স্বভাব ধরা যায় না তাকে যদি গান গাইতে বলা হয় তবে তার মনটা বেরিয়ে আসবে। অর্জুনদাও তেমনি এক ভীষণ ট্যালেন্টেড মানুষ। এখন তো রবীন্দ্রনাথের খুব কঠিন গানও সহজে তুলে নিচ্ছেন। আর স্মৃতিশক্তিও চমৎকার। আমি সুর ভুলে গেলে ওঁকে ফোন করি।
নিজেকে একা লাগে আপনার?
একা ব্যাপারটা তো খুব আপেক্ষিক। ভিড়ের মাঝেও তো একা হওয়া যায়। তবে আমার দেড়শো, দু’শো ছাত্রছাত্রীর সংসারে আমি আর কোথায় একা? ওদের সংসারের একজন হয়ে আমি আজ ঘোরতর সংসারী।
মন খারাপ হলে কী করেন?
ছাত্রছাত্রীদের সমস্যার মধ্যে ঢুকে যাই, ওদের সমস্যার সমাধান খুঁজতে গিয়ে দেখি আমার মন খারাপও উধাও।
নিজের গান শোনেন?
নাহ্! খুব কম। মাঝে মাঝে একলা গীতবিতানটা চালাতে হয় ভুলে যাওয়া সুর খুঁজতে। তবে লোপামুদ্রা, শুভমিতা এঁদের গান শুনি। আর পুরনো গান, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত তো আছেই।
ঘুম ভেঙে বিছানায় প্রথম কি মনে আসে আপনি বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত?
নাহ্, কোনও দিনও নয়। তবে প্রথমেই মনে হয় আমি সা বলতে পারছি তো? আর তার পরেই আমার মা আর আমার বাবা, আমার গুরু পবিত্র দাশগুপ্তের মুখ ভেসে ওঠে। |
|
|
|
|
|