মোহনবাগানের খেলা আর জেমস বন্ডের সিনেমায় বোধহয় এখন আর খুব একটা পার্থক্য নেই! প্রত্যেকটা দৃশ্য-ই যেন নাটক আর থ্রিলারে ভরপুর। কল্যাণী স্টেডিয়ামে রবিবারের দুপুরটা যদি সুব্রত পাল বনাম সবুজ-মেরুন সমর্থকদের ঝামেলা দিয়ে শুরু হয়, তা হলে শেষ হল করিম বেঞ্চারিফা বনাম রেফারির গণ্ডগোলে।
মাত্র নব্বই মিনিটে কী না ঘটে গেল মাঠে? ম্যাচ শুরুর তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যে বিপক্ষের সুব্রত পালের নামে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু হয় গ্যালারি থেকে। জাতীয় দলের গোলকিপারের অপরাধ, তিনি ‘ইচ্ছাকৃত’ দেরি করছিলেন বল মারতে! সুব্রত রেফারিকে অভিযোগ জানাতে আরও উত্তাল হয়ে ওঠে গ্যালারি। শেষ পর্যন্ত পুলিশ নামিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। তবে ক্ষোভের আগুন এতটাই তীব্র ছিল যে, ম্যাচের পরে প্রায় চল্লিশ মিনিট ড্রেসিংরুম-বন্দি থাকতে হয় সুব্রতকে। বাইরে তখন শুধুই ‘সুব্রত গো ব্যাক’ স্লোগান। ঘরের মাঠে সমর্থকদের আচরণ দেখে সুব্রত বলে গেলেন, “এখানে খেলতে আসাই উচিত ছিল না।” |
ওডাফাকে আটকানোর মরিয়া চেষ্টায় সুব্রত। রবিবার কল্যাণীতে। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস |
রবিবার গ্যালারির চাপ আর প্রয়াগের আধা-ফিট দলই কি মোহনবাগানকে বাঁচিয়ে রাখল কলকাতা লিগে? বিপক্ষে র্যান্টি মার্টিন্স ও কার্লোস হার্নান্ডেজ নেই। বেলোরা খেললেন কর্তাদের জোর-জবরদস্তিতে। কেননা শুরুর আধ ঘণ্টা যে ফুটবলটা খেললেন প্রয়াগের ফুটবলাররা, তাতে তাঁদেরই তিন গোলে এগিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্ত ক্রমশ বাড়তে থাকা গ্যালারির চাপ ও র্যান্টির অনুপস্থিতিতে আস্তে আস্তে তলিয়ে গেল প্রয়াগ। এমনকী ম্যাচ শেষ হওয়ার আগে আরও একটা বিতর্ক তৈরি করল লালকমল ভৌমিক-কুইন্টন জেকবের মারামারি। রেফারির জোড়া লাল-কার্ড, চরম বাকযুদ্ধ কিছুই বাদ গেল না। গণ্ডগোলে জড়ালেন করিম বেঞ্চারিফা, রহিম নবিও। ম্যাচের পরে বাগান কোচ রেফারির ঘরে গিয়ে ক্ষমা চাইলেও তাতে বরফ গলেনি। ম্যাচ কমিশনার বললেন, “করিম গালাগালি দিয়েছেন রেফারিদের। রিপোর্টে সেটা উল্লেখ থাকছে।”
বহু দিন বাদে ওডাফা ওকোলির হ্যাটট্রিকে যে সবুজ-মেরুন সমর্থকেরা একটু প্রাণ খুলে আনন্দ করবেন, সেটারও যেন উপায় নেই। ডার্বির আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে বাগানের সবচেয়ে বড় ধাক্কা কুইন্টনের লাল-কার্ড। লালকমলের সঙ্গে অযথা ঝামেলায় জড়িয়ে ডার্বির টিকিট স্বেচ্ছায় বাতিল করে বসলেন নাইজিরিয়ান মিডিও। বাগান মাঝমাঠে একেই বল বাড়ানোর লোক নেই। সেখানে কুইন্টন না থাকায় বাগানের সমস্যা নিশ্চয়ই আরও বেড়ে গেল। করিম অবশ্য বললেন, “আই লিগে অনেক ম্যাচ ওকে ছাড়াই খেলেছি। মনে হয় কোনও অসুবিধা হবে না।” |
কল্যাণীতে ‘কেলেঙ্কারি’ |
ম্যাচ শুরু ৩-০১: সুব্রত পালকে গালিগালাজ গোলপোস্টের পিছনের গ্যালারি থেকে।
৩-০২: রেফারিকে অভিযোগ সুব্রতর। খেলা বন্ধ।
৩-০৫: পুলিশের সঙ্গে সমর্থকদের গণ্ডগোল।
৩-১০: পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে
৪-৪৫: লালকমল-কুইন্টন মারামারি। নবি, সুব্রতরাও জড়ালেন।
৪-৪৬: জোড়া লাল-কার্ড রেফারির।
৪-৪৮: রেফারির দিকে তেড়ে গেলেন করিম। গালিগালাজ।
৪-৫৫: খেলা শেষ।
৫-০৫: রেফারির ঘরে করিম।
৫-৪৭: সমর্থকদের চাপে ড্রেসিংরুম-বন্দি সুব্রত।
৬-০১: কড়া নিরাপত্তায় মাঠ ছাড়লেন সুব্রত। |
|
করিম বহিরঙ্গে আত্মবিশ্বাসের ‘সাইনবোর্ড’ ঝুলিয়ে রাখলেও, তাঁর দলের অন্দরমহলের ছবিটা কিন্তু বেশ নড়বড়ে! বিশেষ করে এ দিনের ম্যাচে যে ফুটবল খেলল মোহনবাগান, তাতে ডার্বিতে খুব নিশ্চিন্ত হওয়া যাচ্ছে না। গগনে গগনে ফুটবল। ছোট পাস কিংবা ‘ওয়াল’ ফুটবলের নামগন্ধ নেই। প্রত্যেকের যেন একটাই লক্ষ্য, ‘বল ধরো আর ওডাফাকে দাও’। আর ওডাফা? এগারো জনের কাজ একা করতে করতে ক্লান্ত। তাও গোলের খিদে মিটছে না। তিনটে গোলই একক দক্ষতায়। একটি পেনাল্টিতে। ডিফেন্সে ইচে থাকলে একটা ভরসা বাড়ত। কিন্তু তাঁরও যে সামনের চার দিনে ফিট হয়ে ওঠা নিয়ে ঘোর অনিশ্চয়তা! যা পরিস্থিতি, তাতে ওডাফা-টোলগে ছাড়া ডার্বিতে এই মুহূর্তে তৃতীয় বিদেশি নেই বাগানের।
এখানেই শেষ নয়। টোলগের দুর্দশা চোখে দেখা যাচ্ছে না। সেই গতি, ‘উইথ দ্য বল’ দৌড় কোথায়? সত্তর মিনিট যেতে না যেতেই হাঁটুতে হাত দিয়ে হাঁফাচ্ছেন। গোটা ম্যাচে চারটে বল ধরেছেন কিনা সন্দেহ! দু’একটা বল যাও বা এ দিক-সে দিক করে পেলেন, সেটাও জমা দিলেন বিপক্ষের পায়ে। কী হল টোলগের আত্মবিশ্বাসের? দু’-এক দিনের মধ্যেই অস্ট্রেলিয়ান স্ট্রাইকারের সঙ্গে মোহন-কর্তারা বসছেন নতুন বছরের চুক্তিপত্র ঠিক করতে। শোনা যাচ্ছে, গত বছরের থেকে ৩০-৪০ শতাংশ টাকা কমতে চলেছে তাঁর। আগাম কোনও ইঙ্গিত পেয়েই কি পারফরম্যান্সের গ্রাফ পড়ছে টোলগের?
কলকাতা লিগের ভবিষ্যৎকে তো ডার্বি ম্যাচ পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেল মোহনবাগান। কিন্তু ট্রফির খরা কি কাটবে?
মোহনবাগান: শিল্টন, নির্মল, নবি, বিশ্বজিৎ, আইবর, মৈথানি, ভার্গব (অর্জুন), সাবিথ, কুইন্টন, ওডাফা (দীপেন্দু), টোলগে (মাসি) |