প্রায়ই তাইল্যান্ডের মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে যেতেন সৌমেন সামন্ত। দেশে ফিরতেন নানা জাতের কুকুর নিয়ে। মেটাতেন কলকাতার সারমেয়প্রেমীদের চাহিদা। কিন্তু আপাতত সে কাজ বন্ধ রাখতে হয়েছে সৌমেনবাবুকে।
সৌমেনবাবুর মতো কাজ বন্ধ রাখতে হয়েছে ভারতের নানা প্রান্তে এই ব্যবসায় যুক্ত অনেককেই। কারণ, কুকুর-বেড়াল বিদেশ থেকে নিয়ে আসা নিয়ে কেন্দ্রের নতুন নিয়ম। ২০০২ সাল পর্যন্ত বিদেশ থেকে কুকুর বা বেড়াল আনতে আনতে গেলে ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ ফরেন ট্রেডের (ডিজিএফটি) কাছ থেকে আমদানির অনুমতি নিতে হত। কিন্তু, লালফিতের ফাঁস নিয়ে নানা অভিযোগের ফলে ২০০২ সালে কিছুটা নিয়ম বদলায় কেন্দ্র। যাত্রী প্রতি দু’টি কুকুর বা বেড়াল নিয়ে আসার অনুমতি দেওয়া হয়। যাত্রীরা নিজের পোষ্য নিয়ে আসছেন বলেই এ ক্ষেত্রে ধরে নেওয়া হয়েছিল। দিতে হত না আমদানি শুল্ক। কেবল পোষ্যের স্বাস্থ্যের শংসাপত্র দিতে পারলেই কাজ চলত। |
কে কত দামি |
পাগ
অন্যতম উৎস দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া
৫০ হাজার টাকার বেশি |
|
|
বিগল
অন্যতম উৎস দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া,
অস্ট্রেলিয়া ৫০ হাজার টাকার বেশি |
জার্মান শেফার্ড
অন্যতম উৎস ইউরোপ
প্রায় দেড় লক্ষ |
|
|
ল্যাব্রাডর
অন্যতম উৎস ইউরোপ
৭০ হাজার থেকে ১ লক্ষ |
ডালমেশিয়ান
অন্যতম উৎস ইউরোপ
৭০ হাজার থেকে ১ লক্ষ |
|
|
বেড়াল
অন্যতম উৎস দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া
প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার |
(আমদানির নতুন নিয়ম চালু হওয়ার আগেকার দাম) |
|
গত ১৫ এপ্রিল থেকে সেই নিয়ম ফের কিছুটা সংশোধন করা হয়েছে। এখনও যাত্রী প্রতি দু’টি কুকুর বা বেড়াল আনার অনুমতি রয়েছে। কিন্তু, যাঁরা বিদেশে অন্তত দু’বছর থাকার পরে ভারতে বসবাস করতে আসছেন, তাঁরাই দু’টি পোষ্য আনতে পারবেন। পোষ্যের বয়স হতে হবে অন্তত দু’বছর। এক কথায়, যাঁরা এ ভাবে কুকুর-বেড়াল আনছেন, তাঁরা যে নিজেদেরই পোষ্য আনছেন, তা নিশ্চিত করতে চেয়েছে কেন্দ্র। অন্য ক্ষেত্রে কেন্দ্রের কাছ থেকে আমদানির অনুমতি নিয়ে আমদানি শুল্ক দিয়ে পোষ্য আনতে হবে।
হঠাৎ কেন এই সংশোধন?
কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তের পিছনে রয়েছে পশুপ্রেমী ও সাংসদ মেনকা গাঁধীর দীর্ঘ প্রচেষ্টা। মানেকা জানিয়েছেন, রাশিয়া, উজবেকিস্তান ও তাইল্যান্ড থেকে হাজার হাজার কুকুর আসছিল ভারতে। যে সব ব্যবসায়ী এই কুকুরগুলি বিদেশের ‘ব্রিডারদের’ কাছ থেকে নিয়ে আসত তারা নেটে অর্ডার দিত। নিজেদের ঠিকানাও দিত না। ভারতে ক্রেতাদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার পরে বিদেশের ‘ব্রিডারদের’ খবর দেওয়া হত। নিজের পোষ্য সাজিয়ে আমদানি শুল্ক ফাঁকি দিয়ে কুকুর-বেড়াল নিয়ে আসত কোনও বিদেশি দালাল।
মেনকা আরও জানাচ্ছেন, রীতিমতো মাফিয়া দলের মতো কাজ করত কিছু পোষ্য ব্যবসায়ী। তাইল্যান্ড থেকে একসঙ্গে ১০টি কুকুরছানা কিনে কাস্টমসকে ঘুষ দিয়ে নিয়ে আসত দেশে। এই কুকুরছানাগুলির বিশেষ যত্নও নেওয়া হত না। ফলে, তারা ভারতে বয়ে নিয়ে আসত পার্ভো, র্যাবিস, ডিসটেম্পারের মতো রোগ।
নতুন নিয়মের ফাঁদে পড়ে গিয়েছেন দেশের অনেক পোষ্য ব্যবসায়ী। আমদানির লাইসেন্স তৈরি না করে কুকুর-বেড়াল আনা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তপন চৌধুরী, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, অরবিন্দ্র সিংহ, সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের মতো সারমেয়প্রেমীদের প্রশ্ন, যারা নিজেদের শখ মেটাতে সব নিয়ম মেনে বছরে একটি বা দু’টি পোষ্য আমদানি করতে চান তাঁদেরও কেন এই নিয়মের ফাঁদে পড়তে হবে?
তপনবাবুর কথায়, “ধরুন বিদেশে কেউ আমাকে একটা কুকুর উপহার দিল। নতুন নিয়মে এখন আমি সেই কুকুর দেশে আনতে পারব না। আমদানির অনুমতির জন্য অপেক্ষা করতে হবে।’’ তাঁর মতে, একটি বা দু’টি কুকুর আনার ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় দেওয়া প্রয়োজন। পোষ্যের সংখ্যা অনেক বেশি হলে কড়াকড়ি করা যেতেই পারে।
আমদানির অনুমতি নিয়ে কুকুর-বেড়াল আনতে তো অসুবিধা নেই। তবে সে পথে হাঁটতে আপত্তি কোথায়? প্রসেনজিৎবাবু জানাচ্ছেন, বাধা দু’টি। এক দীর্ঘসূত্রিতা, দুই খরচ। আমদানির অনুমতি পেতে প্রথমে আবেদন করতে হবে ডিজিএফটি-র কাছে। সেই অনুমতি পেলে ফের আর্জি কেন্দ্রীয় পশুপালন ও দুগ্ধজাত দ্রব্য উৎপাদন মন্ত্রকের কাছে। সব বাধা কাটিয়ে আমদানির অনুমতি পেতে কেটে যাবে অনেক সময়। পাশাপাশি পোষ্যের মূল্যের উপরে ২০০ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে। আমদানি করা ভাল কুকুরের দাম অনেক ক্ষেত্রেই বেশ বেশি। তার উপরে ২০০ শতাংশ শুল্ক দিতে হলে খরচের বহরটা অনেক বেড়ে যায়।
অরবিন্দ্র সিংহের কথায়, “ডিজিএফটি অফিসে গিয়ে কুকুর আমদানির অনুমতির কথা বললে কর্মীরা হেসে উড়িয়ে দেন। এখনও বিষয়টি নিয়ে খুব সচেতন নন তাঁরা।” সুব্রত মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, এখনও দেশে আদতে বিভিন্ন বিদেশি প্রজাতির কুকুরের যথেষ্ট চাহিদা। আমদানি বন্ধ হলে নতুন নতুন রক্তধারার (ব্লাড লাইন) কুকুর আসা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে, প্রজননের ক্ষেত্রে প্রবল সমস্যা দেখা দেবে।
তবে উপায় কী? কেন্দ্রের নতুন নিয়মের বিরুদ্ধে আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার কথা ভাবছেন চেন্নাই, বেঙ্গালুরু-সহ ভারতের নানা প্রান্তের অনেকে। আদালত কোনও পথ দেখায় কি না সেদিকেই এখন তাকিয়ে সবাই। |