|
|
|
|
ছিল গোয়েন্দা গল্প, হয়ে গেল কমেডি |
অর্জুনের তিরটাই কিছুটা ভ্রষ্ট। লিখছেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্য |
এক নতুন সীতাহরণ পালা দেখা গেল রুপোলি পর্দায়। তবে সপ্তকাণ্ড রামায়ণের নয়। এক চমকচোস্ত আধুনিকার, যারও নাম সীতা। মার্কিন মুলুকে বেড়ে উঠে দেশে ফেরা বলে তার ডায়ালগে থেকে-থেকেই এসে পড়ে আমেরিকান ‘ড্রল’ বা গড়ানো টান। ফলে তাকে এক এক সময় ডেকেও ফেলা হয় ‘সিটা’ বলে। এই নব সীতাহরণের পটভূমি অরণ্যই, তবে সাহেবিয়ানার ছোঁয়াধরা কালিম্পং বনাঞ্চল। অপহরণের রাবণ কে, তা উচ্চারণও করা যাবে না, কারণ কাহিনি অপরাধমূলক ও গোয়েন্দা-জড়িত। এবং এই ছবি দিয়ে দাবি করা হচ্ছে যে বাংলা সিনেমায় ব্যোমকেশ ও ফেলুদার এক একবিংশ শতকীয় উত্তরসূরি এল। এল কি?
|
|
অর্জুন হল সমরেশ মজুমদারের আশির দশকের গোড়ায় লেখা ‘কালিম্পং-এ সীতাহরণ’ উপন্যাসের চিত্ররূপ। আজকের প্রজন্মকে টানার মতো একশো উপকরণ কাহিনিতে। প্রথমত, ফেলুদার মতো এক অতি বিচক্ষণ ও আকর্ষক প্রবীণ শখের গোয়েন্দা অমল সোম এবং ওঁর তোপসে গোছের সদ্য যুবা অর্জুন। দ্বিতীয়ত, এক দুর্দম আন্তর্জাতিক অপরাধ চক্র, ড্রাগ-খুন-চোরাচালান ইত্যাদি নিয়ে সর্বঘটে অক্ষপুটে সাকার-আকার-নিরাকার। ভারতীয় গোয়েন্দাদের মনিটরে চক্রের নেতা ভাস্বর কিন্তু অধরা। তৃতীয়ত, এক অপরূপ নিসর্গ, চোখজুড়োনো বাংলো বাড়ি এবং লুকোনো প্রেম, লুকোনো ধন এবং পর-পর খুন। দু’ঘণ্টা দশ মিনিটের ছবিতে আর বেশি কী চাইতে পারে আজকের প্রজন্ম?
চাইতে পারে গোয়েন্দা কাহিনির এক সরল, বিভ্রান্তিহীন পরিবেশনা। তা হলে জিজ্ঞাস্য হয়, কাহিনিটি কী? ছোট্ট করে বললে মার্কিন দেশে দিব্যি ব্যবসা করতে করতে সীতার বাবা পাততাড়ি গুটিয়ে চলে এসেছেন দেশে এবং আরামসে গুছিয়ে বসেছেন কালিম্পং-এ এক চমৎকার ভিলায়। তিনি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন তাঁর সদ্য যুবতী কন্যাকেও, যে রীতিমতো ক্ষুব্ধ মার্কিন প্রেমিকের থেকে বিযুক্ত হয়ে। ফলে তার ব্যবহার ও রকমসকম বোঝা দায়। তাকে দেখাশোনা ও পরিচর্যার জন্য বাবা নিয়োগ করেছেন এক স্থানীয় মহিলা মিস ওয়াংদিকে।
এই মিস ওয়াংদিরও নিজস্ব অ্যাজেন্ডা আছে। সে ওই বাড়িতে কাজের বাহানায় তল্লাশে আছে এক বিখ্যাত মনাস্টেরির স্থাপত্য ছকের, যে ছক হাতে এলে অমূল্য ধনরত্ন করায়ত্ত হবে। আর ওই ছকের খোঁজে পূর্ববর্ণিত চিনা মাফিয়াও।
এই রকম এক পরিস্থিতিতে কালিম্পং এলেন অমল সোম। সীতার বাবা তাঁকে নিয়োগ করলেন সীতার সম্ভাব্য অপহরণ এড়াতে। কেন সীতাহরণের আশঙ্কা এবং কেনই বা পুলিশকে জানানো নয়? অমলের এই প্রশ্নের উত্তরে বাবা যা জানালেন, তা দর্শককে শুনতে দেওয়া হল না। দর্শক শুধু দেখল অমল তাঁর শিষ্য অর্জুনকে থাকতে পাঠালেন সীতাদের বাংলোয় নজরদারি চালানোর জন্য। তাতেও সীতাহরণ ও দু’দুটো খুন ঠেকানো গেল না। খেলা জমে গেল।
খেলা সত্যি জমল কি? একের পর এক ঘটনা ঘটেই চলেছে কেবল ঘটার জন্যই। সমরেশ মজুমদারের বৃত্তান্তের সরলতা ক্রমশ উবে গিয়ে অভিজিৎ সরকারের চিত্রনাট্য, প্রেম প্রকাশ মোদির পরিচালনা ও বোধাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনার জটিলতা ভর করল ছবিকে। গল্প যে কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছে সে হাল ছেড়ে দর্শক হাসির সংলাপে হাসতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রানা দাশগুপ্তর তোলা মনোরম দৃশ্যাবলিতে মন গুঁজে দিল। রহস্য কাহিনি ঢলে পড়ল সরস কাহিনিতে।
কৌতূহলে হোক চাই কৌতুকে, পুরোটা সময় যে কাটিয়ে দেওয়া গেল তার কারণ ছবিটার মধ্যে কোথায় যেন একটা সহজ বিনোদন আছে। সীতার জন্য তো একটা উৎকণ্ঠা তৈরিই হয়। বিশেষ করে নবাগতা রায়া চৌধুরী যে ভাবে সুন্দর ফুটিয়েছে সীতার আবেগ, তাড়না ও রোম্যান্স। বিনোদনের এক বড় অংশ সব্যসাচী চক্রবর্তীর অমল সোম, যাঁকে ফেলুদার পরিণত মুখ বলে ভুল করা যায়। যদিও ওম-এর অর্জুনকে ফেলুর উত্তরাধিকারী বলাটা, ভাইচুং ভুটিয়াকে পেলে-মারাদোনার উত্তরসূরি বলার দাখিল। ওম-কে আগামী ছবিতে আরও স্পষ্ট করে অর্জুন হয়ে উঠতে দেখতে চাই।
খুব সুন্দর চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায়ের মিস ওয়াংদি। চোখমুখের ব্যবহার, খুঁড়িয়ে হাঁটা, স্টাইলের কথা, কিঞ্চিৎ নেপালি বলা, সব মিলিয়ে বেশ একটা প্যাকেজ। বেশ হাসিয়েছেন বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী। কিছুটা মনোজ মিত্রও। এবং সীতার বাবা হিসেবে এত সব গোলমেলে পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে দীপঙ্কর দে’কে যে ওঁর অভিনয়ের সেই স্বভাবদীপ্তি কিছুটা হলেও আড়াল। তা হলেও সব্যসাচীর মতো ছবিতে ওঁর উপস্থিতিটাই অনেকখানি।
ব্যোমকেশ, ফেলুদা ও কাকাবাবুর পর অর্জুন যদি আর একটা সিরিজ চরিত্র হয়, বাংলা ছবিতে সেটা ভালই হবে। ভূত, হাসি, রহস্য বাংলা ছবির দারুণ রসদ ছিল এক কালে। তা যদি নবকলেবরে, দাপটের সঙ্গে ফিরে আসে, তবে ঢের ছিঁচকাদুনি ও প্যানপ্যানানি থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।
‘অর্জুন’-এর ভুলভ্রান্তি থেকে নির্মাতারা শিক্ষা গ্রহণ করুন এটাই চাইবে সবাই। |
|
|
|
|
|