জমি নিয়ে নিজেদের অবস্থানে অনড় থেকেই শনিবার খসড়া শিল্পনীতি প্রকাশ করল তৃণমূল সরকার। ফলে দীর্ঘ টালবাহানার পরে সরকারের দু’বছর পূর্তির মুখে শিল্পনীতির রূপরেখা হাতে পেয়েও তা নিয়ে খুব একটা আশার আলো দেখছে না রাজ্যের শিল্পমহল। এ রাজ্যে শিল্পায়ন যে জটে আটকে রয়েছে, নতুন শিল্পনীতি তা থেকে মুক্তির কোনও দিশা দেখাতে পারবে না বলেই সংশ্লিষ্ট মহলের আশঙ্কা।
দু’বছর আগে ক্ষমতায় আসার পরেই নতুন শিল্পনীতি তৈরির কথা ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বর্ষীয়ান তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়কে শিল্প উপদেষ্টা পদে নিয়েগ করে সেই নীতির খসড়া তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি খসড়া জমা দেওয়ার পরে চলতি বছরের গোড়ায় হলদিয়ায় ‘বেঙ্গল লিডস’-এর আগে শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, সম্মেলনে শিল্পনীতি ঘোষণা করবেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়। অবশেষে শনিবার মহাকরণে খসড়া শিল্পনীতি প্রকাশ করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “এ দিন ওয়েবসাইটে যে খসড়া প্রকাশ করা হল, ৩০ জুন পর্যন্ত তার উপর মতামত নেওয়া হবে। তার পর আমরা আলোচনা করে শিল্পনীতি চূড়ান্ত করব।” তৃণমূল সূত্রে বলা হচ্ছে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের অংশগ্রহণ চায় সরকার। তাদের মতামত গ্রহণের লক্ষ্যেই খসড়া শিল্পনীতি প্রকাশ করা হয়েছে। আগামী প্রায় দেড় মাস এই খসড়া সম্পর্কে যে সব মতামত আসবে, তার মধ্যে কিছু বিবেচনার যোগ্য মনে হলে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে তা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছেন শিল্পমন্ত্রী। |
বস্তুত, খসড়া নীতি তৈরি করার আগেও বণিকসভাগুলির মতামত নিয়েছিল রাজ্য সরকার। সেই সব সুপারিশের প্রতিফলন খসড়ায় হয়েছে, সে সম্পর্কে এখনই মুখ খুলতে নারাজ বণিকসভাগুলি। তবে এখন পর্যন্ত শিল্পনীতির যা চেহারা, তাতে বড় শিল্পের জন্য দরজা খোলার কোনও আশাই দেখছে না শিল্পমহল। তাদের মতে, বড় শিল্পের জন্য জমি মিলবে কোথা থেকে, সেই প্রশ্নের কোনও সদুত্তর খসড়া নীতিতে নেই। বেসরকারি এবং যৌথ উদ্যোগের প্রকল্পের জন্য সরকার যে জমি নেবে না, তা আরও এক বার স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে খসড়া শিল্পনীতিতে। তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পকে বিশেষ আর্থিক অঞ্চল (এসইজেড) হিসেবে ঘোষণা করার দাবিও যে মানা হবে না, খসড়ায় একটি শব্দও ব্যবহার না করে তা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। জমির উর্ধ্বসীমা আইনও তুলে দেওয়ার কোনও ইঙ্গিত দেওয়া হয়নি খসড়া শিল্পনীতিতে।
বস্তুত, বড় শিল্প নয়, ছোট ও মাঝারি শিল্পের দিকেই যে তাঁর সরকার তাকিয়ে, সে কথা এ দিন আরও এক বার বুঝিয়ে দিয়ছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, “সরকারের এই নতুন নীতি রূপায়ণের ফলে শিল্প আসবে। ক্ষুদ্র শিল্পে কর্মসংস্থান বাড়বে। এই শিল্পে বাংলা সারা বিশ্বকে জয় করতে পারে। এই শিল্পের জন্য কোটি-কোটি টাকা ঢালতে হবে না। গ্রামীণ হাট, গ্রামীণ শিল্পকে উৎসাহ দেওয়াই সরকারের লক্ষ্য। সবার কথা ভেবেই এই সার্বিক নীতি।” শিল্প মহলের পাল্টা বক্তব্য, ছোট ও মাঝারি শিল্পের প্রয়োজন আছে ঠিকই। কিন্তু বড় শিল্প ছাড়া কোনও রাজ্যের অগ্রগতি সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে গুড়গাঁও ও চেন্নাইয়ের গাড়ি শিল্পের প্রসঙ্গ টেনেছেন শিল্প কর্তারা। বৃহৎ গাড়ি শিল্পের দৌলতেই সেখানে ছোট ও মাঝারি শিল্পের বাড়বাড়ন্ত বলে তাঁদের দাবি।
খসড়া নীতিতে উৎপাদন শিল্পে জোর দিয়ে রাজ্যের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে (এসডিপি) তার অবদান আগামী পাঁচ বছরে ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু জমি নিয়ে সরকারের চলতি অবস্থান সেই লক্ষ্য পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়াবে বলেই শিল্পমহলের আশঙ্কা। তার উপরে রয়েছে প্রবেশ করের বোঝা। ছোট ও মাঝারি শিল্পের ক্ষেত্রে প্রবেশ করে ভর্তুকি দেওয়ার কথা বলা হলেও বড় শিল্পে সেই সুবিধা নেই।
এসইজেড নিয়ে খসড়া নীতিতে সরকার কোনও রা না-কাড়াতেও হতাশ শিল্পমহল। রাজারহাটে ইনফোসিসের প্রকল্পকে এসইজেড তকমা দেওয়া নিয়ে টানাপোড়েন চলছে। এই সুবিধা না-পেলে প্রতিযোগিতার বাজারে তাদের পক্ষে প্রকল্প গড়া সম্ভব নয় বলে বারবারই জানিয়ে দিয়েছে ইনফোসিস। রাজ্যের এক প্রথম সারির শিল্পপতির কথায়, “এক দিকে ইনফোসিসের লগ্নির প্রস্তাব, অন্য দিকে এসইজেড নিয়ে শাসক দলের অবস্থান। এই জট কাটাতে মাঝামাঝি রাস্তার হদিশ দিয়েছিল কয়েকটি বণিকসভা। কিন্তু নয়া শিল্প নীতির খসড়ায় এই নিয়ে কোনও উল্লেখই নেই।” আর এক শিল্পকর্তার মতে, “পশ্চিমবঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে লগ্নি টানতে এসইজেড-এর সদর্থক ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে এসইজেড সংক্রান্ত অনুমোদন না-দিলেও এর বিকল্প ব্যবস্থা রাজ্যের ভাবা উচিত ছিল।”
খসড়া শিল্পনীতির সঙ্গেই নতুন শিল্পের জন্য আর্থিক অনুদান প্রকল্প ঘোষণা করেছে রাজ্য। কিন্তু বণিকমহলের প্রশ্ন, যেখানে ‘ইনসেনটিভ’ বাবদ বহু টাকা ইতিমধ্যেই শিল্প সংস্থাগুলিরপ্রাপ্য, সেখানে নতুন অনুদান প্রকল্প ঘোষণার মানে কী? সরকার কোথা থেকে এই টাকা দেবে, সেই প্রশ্নও তুলেছেন তারা। অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র অবশ্য বলেছেন, “নতুন বিনিয়োগকারীদের জন্যই এই সুবিধা। এই ছাড় দেওয়া হলেও রাজস্ব কমবে না, বাড়বে।”
খসড়া শিল্পনীতি প্রসঙ্গে শিল্পমন্ত্রী এ দিন বলেন, “খসড়া তৈরির সময় ৮-১০টি রাজ্যের শিল্পনীতিকে সামনে রেখেছি। শিল্পস্থাপন করলে তার জন্য উৎসাহদান প্রকল্পকে বাস্তবসম্মত করার চেষ্টা করেছি। বিনিয়োগকারীদের আস্থাভাজন হওয়ার চেষ্টা করেছি।” |