|
|
|
|
|
|
|
একটা ভয় কষ্টলজ্জাঘেন্না |
সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় |
কেউ যখন আত্মহত্যা করে তখন কী তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় যে এত বড় সিদ্ধান্ত সে মুহূর্তে নিয়ে ফেলে? সে তো নিজে নিশ্চয়ই জানে যে দড়িটা যখন গলায় কেটে বসবে তখন খুব খুব কষ্ট হবে! কিংবা যখন আগুন চিড়বিড় করে পুড়িয়ে দেবে তার কোমল চন্দন মাখা, রোজ পরিচর্যা করা নরম ত্বক, তখন? এ কথাগুলো কি তারা কেউ ভাবে না, বছর চোদ্দোর ফেল-করা-ছেলে কিংবা ৭৬ বছরের বিষাদগ্রস্ত বৃদ্ধ? না কি তখন বেঁচে থাকার যন্ত্রণাটা অনেক বেশি দাগা দেয়? মানসিক যন্ত্রণা না হয় ছেড়েই দিলাম, এত যত্নের, এত আপন নিজের শরীর, তাকেও এত কষ্ট দেওয়া যায়? নিশ্চয়ই যায়। না হলে আর রোজ রোজ এত মানুষ এই কাণ্ডটা করছে কী করে?
ভাবতে গেলে ভেতরটা ভয়ে শুকিয়ে যায়। কাল অবধি এক জন নেহাত আমাদের মতোই স্বাভাবিক ছিল। তিক্ততা, ইরিটেশন, হঠাৎ ভাললাগা, ঠায় সন্ধে থেকে টিভি দেখা এ সবই তারও আঁতিপাঁতি জীবন ছিল। রাত দুটোর সময় তার মনে এমন কী জেগে উঠল যে ধোঁয়া দেখে পড়শিরা ছুটে গেল ঝলসানো দেহটা টেনে বার করতে? আচ্ছা তখন কি ব্রেন কাজ করে না? কতটা সময় তার ব্রেন নিজের আয়ত্তে না থাকলে এই কাজ করা যায়? কিংবা কেউ কেউ তো বুঝেশুনে, বহু দিন ধরে সমস্ত ডিটেল প্ল্যান করে, এই সিদ্ধান্ত নেয়! তার মানে তার কাছে জীবন তখন নেহাত একটা ফাঁপা তেতো বোঝা, মৃত্যু তাকে দেবে পালিয়ে যাওয়ার লাইসেন্স। যে কোনও মূল্যে সে এই জীবনটাকে ক্যানসেল করতে চায়।
আমার ভয় একটাই। এই যে আমার একটা প্রাত্যহিক, অনাড়ম্বর জীবন ওই ওদের মতো, তা হলে আমারও কি জীবনে এমন কোনও মুহূর্ত আসতে পারে, যখন আমি ওই স্তরে পৌঁছে যেতে পারি? যখন আমি আর কিছু ভাবব না? যখন আমিও জীবনকে ক্যানসেল করে দিতে চাইব? আমার কাছেও তখন শারীরিক যন্ত্রণা, আমায় ঘিরে থাকা সম্পর্করা, আমার গোপনতম এক্সাইটমেন্ট সবের ঊর্ধ্বে মৃত্যুই কাম্য হয়ে দাঁড়াবে? আমার পেট গুড়গুড় করবে না? আমার ভয়ে বুক কাঁপবে না? আমার মনে হবে না এক বারও যে আমি চলে যাবার পর আবার নতুন সিনেমা আসবে, দুর্গাপুজো হবে, বসন্তকাল আসবে অথচ ইচ্ছে করে আমি কিছুতে অংশগ্রহণ করব না? যত ভাবি, মনে হয়, এ রকম দিন আসতে পারেই তো। কারণ যে মেয়েটা বা যে বৃদ্ধ বা যে মাঝবয়সি একদম আমার মতো সাধারণ ছিল, কোনও অর্থে যাদের মস্তিষ্কে বিপ্লব বা চিটিংবাজি বা অসতীত্ব বা হননেচ্ছা বা স্কিৎজোফ্রেনিয়া কোনওটাই ছিল না, তারাও তো একটা সময় এই স্তরটায় পৌঁছেছে। কাল এমন কোনও পরিস্থিতি যদি হয় যে আমি নিজেকে সামলাতে পারলাম না আর ওই জায়গাটায় পৌঁছে গেলাম, তা হলে কি আমিও আত্মহত্যা করব?
আমি ম্যানেজমেন্ট গুরুদের মতো হয়তো নিংড়ে জীবন বাঁচিনি। আমার জীবন হয়তো অনেক সময়ই খুব বোরিং, বৈচিত্রহীন, তবু আমার জীবন খুব ভাল লাগে। কিন্তু আমি যখন ওদের কথা ভাবি, তখন নিজেকে কোনও গ্যারান্টি দিতে পারি না যে আমি কোনও দিন ওই জায়গায় পৌঁছব না। আর তখন কী বিস্বাদ লাগে জিভটা। মনে মনে ধমকে নিজেকে বলি, বাজে না বকে অন্য কথা ভাব। রণবীর কপূরের সিনেমায় ওই গানটা কী যেন? কিন্তু কিছুতেই মনকে চোখ ঠেরে থাকতে পারি না।
অনেক সময় স্বপ্ন দেখি, এই এক্ষুনি ডুবে যাচ্ছিলাম জলে, দম আটকে আসছিল, তলিয়ে যাচ্ছিলাম, উফ বুকের কাছটায় কী কষ্ট হচ্ছে, পারছি না, এই রে, আমি কি তা হলে মরে যাচ্ছি?.. ঠিক তখনই ঘুমটা ভেঙে যায়। গা ভিজে সপসপে। ভাবি, যাক, এ যাত্রা বেঁচে গেলাম। ঢকঢক করে জল খাই। শেষ মুহূর্তে বেঁচে যাওয়ার স্বস্তি বার বার মনে করিয়ে দেয়, বাবাঃ! তা হলে বেঁচে আছি এখনও। আর তাতেই আমার কী কষ্ট হয়।
তা হলে আমি যদি সত্যি কখনও ওই জায়গাটায় পৌঁছই? |
|
|
|
|
|