|
|
|
|
|
|
শিল্প যখন ঠোঁটকাটা থাপ্পড়বান |
আজকের হিরো: চেলসি হোটেল ম্যানিফেস্টো
|
গৌতম চক্রবর্তী |
আমি ছবি এঁকেছি জীবন্ত তুলিতে। মডেলদের নগ্ন শরীর রঙে চুবিয়ে।...সেই জীবন্ত তুলিরা নড়াচড়া করত আমারই নির্দেশে। আর একটু ডান দিকে, এ বার উপুড় হয়ে ঘুরে যাও।....১৯৬১ সালে এই ভাবেই তাঁর ম্যানিফেস্টো লিখেছিলেন ফরাসি শিল্পী ইভ ক্লে।
মডেলদের রঙে চুবিয়ে, টেনে গড়াগড়ি দিইয়ে তৈরি হয়েছিল ক্লেঁ-র বিখ্যাত ‘মোনোটোন সিম্ফনি’। প্রথমে গাঢ় নীল রঙে মডেলদের শরীর রাঙিয়ে দেওয়া হত। তার পর, ক্যানভাসের উপরে সেই মডেলরা ক্লেঁ-র নির্দেশমতো গড়াগড়ি দিতেন। বিভিন্ন মাত্রায় উজ্জ্বল হয়ে উঠত সেই নীলাভ অবয়ব।
এই নীল অন্য রকম। লাপিস লাজুলি, প্রুশিয়ান ব্লু, স্কাই ব্লু, ইজিপ্শিয়ান ব্লু-র চেয়ে আলাদা। অয়েল পেন্টিং-এর ক্ষেত্রে রংটি ‘লিনসিড অয়েল’ বা তিসির তেল মিশিয়ে ব্যবহার করা হত। ইভ এটিকে ‘রোডোপসাস’ নামে এক রাসায়নিক যৌগের সঙ্গে মিশিয়ে হরেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, নীল হয়ে উঠেছে আরও ঘন, আরও বন্য। শিল্পীর নামে রংটির নামই হয়ে গিয়েছে ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্লেঁ ব্লু’ (IKB)। দুনিয়ায় কচি সবুজ, গাঢ় সবুজ, কলাপাতা সবুজ অনেক রং-ই আছে, কিন্তু শিল্পীর নামে রঙের আকাশ আগে কখনও এ ভাবে রঞ্জিত হয়নি।
ক্যানভাসের উপরে নগ্ন সুন্দরীদের গড়াগড়ি, পাশে গ্যালারিতে চেলো, ভায়োলিন ইত্যাদি নিয়ে কুড়ি মিনিটের সিম্ফনি। তার পরই কুড়ি মিনিটের সমান নীরবতা। ‘নৈঃশব্দ্যই আমার সিম্ফনি’, বলতেন ক্লে।
ক্লেঁ এই সব ছবির নাম দিয়েছিলেন ‘অ্যানথ্রপোমেট্রি’। এই নৃতাত্ত্বিক পরিমাপে ব্যবহার করা হত রোদ, ঝড়, বৃষ্টিও। ম্যানিফেস্টোয় স্মৃতিচারণ, হাইওয়ে ধরে শিল্পী প্যারিস থেকে নিস শহরে পাড়ি দিচ্ছেন ঘণ্টায় ১০০ কিমি বেগে। গাড়ির ছাদে বেঁধে-রাখা সদ্য রং-করা ক্যানভাস। রোদ, আলো, হাওয়া, বৃষ্টি আছড়ে পড়ছে, ক্যানভাস ক্রমে হয়ে পড়ছে জরাগ্রস্ত। ‘তিরিশ থেকে চল্লিশ বছরের সময়সীমা এ ভাবেই কমিয়ে এনেছিলাম এক দিনে’, লিখেছেন তিনি। শিল্পীরা সাধারণত কী করতে চলেছেন, তা নিয়েই ম্যানিফেস্টো রচনা করেন। কিন্তু ইভ ক্লেঁ-র ম্যানিফেস্টোটি অন্য রকম। দেড় দশকের শিল্পীজীবনে তিনি কী করেছেন, কেনই বা করেছেন, তার সুদীর্ঘ বিবৃতি। ‘আমার শিল্পচর্চারও ইতিহাস আছে। সেটিই শব্দের ছবিতে এখন তুলে ধরছি। তার পরই নেমে আসবে বিশুদ্ধ নৈঃশব্দ্য’, ম্যানিফেস্টোয় লিখেছেন তিনি। ঘটনাচক্রে নিউ ইয়র্কের চেলসি হোটেলে এই ম্যানিফেস্টো লেখার পরের বছর, ১৯৬২ সালের মে মাসে কান চলচ্চিত্র উৎসবে সিনেমা দেখতে দেখতে শিল্পীর হার্ট অ্যাটাক। এবং কয়েক দিন পরে তিনি চিরনৈঃশব্দ্যের পৃথিবীতে।
চেলসি হোটেলে, তেত্রিশ বছর বয়সে লেখা ইভ-এর এই ম্যানিফেস্টোর নাম ‘চেলসি হোটেল ম্যানিফেস্টো’। শিল্পীর নামে নীল রঙের মতো, এই ঘটনাটিও অভাবিত। হোটেলের নামে শিল্পের ম্যানিফেস্টো তার আগে, পরে কখনও হয়নি।
|
|
আর ষাটের দশকে, নিউ ইয়র্কের সেই চেলসি হোটেল? আত্মঘাতী মাতাল, কবি, শিল্পী এবং বোহেমিয়ানদের এমন অনন্য আখড়া আর কখনও হল না। ওই চেলসি হোটেলেই চূড়ান্ত মদ্যপ অবস্থায় কোমায় ঢলে পড়লেন ডিলান টমাস, ওখানেই জ্যাক কেরুয়াক লিখছেন ‘অন দ্য রোড’, গান বাঁধছেন বব ডিলান, লিয়োনার্ড কোহেন। চেলসি হোটেলের মেয়েদের নিয়ে ছবি তৈরি করছেন অ্যান্ডি ওয়ারহল, আমেরিকা সফরে এসে ডেরা বাঁধছেন জাঁ পল সার্ত্র ও সিমোন দ্য বোভোয়া, মেরিলিন মনরোর সঙ্গে ডিভোর্সের পর প্রেসকে এড়াতে চেলসি হোটেলেই থাকছেন নাট্যকার আর্থার মিলার। সেই হোটেলেই উঠতেন ইভ ক্লেঁ, সেখানেই লেখা হয় এই ম্যানিফেস্টো।
ম্যানিফেস্টোয় বার বার এসেছে ‘ভয়েড’ বা শূন্যতার কথা। পাঁচের দশকের শেষে এক আর্ট গ্যালারিতে ইভ ক্লেঁ-র প্রদর্শনী। পুরো গ্যালারি ফাঁকা, দেওয়ালগুলিতে সাদা রং, এক দিকে একটি ক্যাবিনেট। ঘরে ঢোকার মুখে নীল পরদা। ‘এই যে অ্যাবসলিউট ভয়েড বা চূড়ান্ত শূন্যতা, এটিই সত্যকার ছবির পরিসর।... ছবি দেখাটা দর্শকের ‘গেজ’ বা চাউনি-বিন্যাসের ওপর নির্ভর করে না। ছবি বোঝার অনুভূতি আমাদের অস্তিত্বের বাইরে। তবু কোনও-না-কোনও ভাবে সে রয়ে যায় আমাদের পরিসরে’, ম্যানিফেস্টোয় জানাচ্ছেন ক্লে। সমসাময়িক শিল্পবোদ্ধারা এই সব লাইনের কারণে ম্যানিফেস্টোটিকে আঁতেল, দুর্বোধ্য ইত্যাদি নানা আখ্যায় ভূষিত করেন।
নব্বইয়ের দশক থেকে শিল্পকলার ইতিহাসবিদ ও সমঝদারদের কাছে ওই দুর্বোধ্য এবং আঁতেল পংক্তিগুলিই নিয়ে আসে অন্য মাত্রা। তত দিনে জানা গিয়েছে, যৌবনের কয়েক বছর জাপানে কাটিয়েছিলেন ক্লে।ঁ জুডোয় তিনিই প্রথম ইউরোপীয় ব্ল্যাক বেল্ট। ক্লেঁ-র ‘শূন্যতা’ মানে গ্যালারিতে থাকছে না ছবি বা কোনও বস্তু। বিষয়হীনতার মধ্যেই বিষয়ীকে অনুভব করতে হবে সক্রিয় এক শূন্যবোধ। প্রসঙ্গত, জাপানের জেন বৌদ্ধধর্ম বার বার বলে, অনুভবই আসল কথা। আধ কাপ চা সামনে থাকলে তুমি কাপটি অর্ধেক পূর্ণ বলে অনুভব করতে পারো। অর্ধেক শূন্যও মনে করতে পারো। জেন ধর্ম তা হলে প্রভাব ফেলেছিল ক্লেঁ-র শূন্যতাবোধে? কেনই বা ম্যানিফেস্টোর শেষ দিকে লিখলেন, ‘কোনও ক্ষেপণাস্ত্র, রকেট বা স্পুতনিক দিয়ে নয়। মানুষ তার চার পাশে শূন্যতার পরিসরকে জয় করতে পারে বোধ, মনন এবং অনুভূতি দিয়ে।’ প্রসঙ্গত, বৌদ্ধ দর্শনে পাঁচটি নয়, ছয়টি ইন্দ্রিয়। চোখ, কান, নাক, জিভ এবং ত্বকের পাশাপাশিই সমান গুরুত্ব নিয়ে থাকে মন।
অনুভূতিঋদ্ধ এই মনই বলে দেয়, এটি ভাল। ওটি খারাপ। কিন্তু ভাল-খারাপ বলে তো কোনও মার্কা থাকে না। গোটাটাই নির্ভর করে তোমার ধারণার ওপর। ‘কুরুচি শব্দটা আমাকে খুব উত্তেজিত করে। কুরুচির অন্তঃসারে খুঁজতে খুঁজতে হয়তো এমন কিছু মিলবে, যা তথাকথিত শিল্পের দিগন্ত ছাড়িয়ে যায়’, ম্যানিফেস্টোয় লিখেছিলেন ক্লে।
কুরুচি শব্দটি গুরুত্বপূর্ণ। ক্লেঁ তাঁর ম্যানিফেস্টো রচনার উদ্দেশ্য প্রথমেই পরিষ্কার করে দেন, ‘অনেকে বলেন, শিল্পের জগতে আরও আবর্জনা ছড়ানোর আগে আমার অচিরে ধ্বংস হয়ে যাওয়া উচিত।’ ক্লেঁ-র প্রদর্শনীতে তখন কখনও নগ্ন মডেলরা পরস্পরকে টানতে টানতে তৈরি করছেন সিম্ফনির সাঙ্গীতিক শূন্যতা, কখনও বা আগুন ছড়াচ্ছেন ব্লো পাইপে।
ম্যানিফেস্টোয় আগুনের চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন ক্লে। ‘আসলে মানুষের হৃদয়ে যে আগুন আছে, শূন্যতার হৃদয়েও সেই শিখা চিরবহ্নিমান।’ ঋগ্বেদের প্রথম সূক্তটিও তো এ রকমই, ‘আমি অগ্নির স্তুতি করি।’ কে জানত, আত্মঘাতী মাতাল, কবি ও বোহেমিয়ানদ |
|
|
|
|
|