|
|
|
|
|
|
|
সুমনামি |
কবীর সুমন |
এই তো সে দিন আবার এক পরিচিত ব্যক্তির মুখে শুনতে হল, ‘হেমন্তের গলায় রবীন্দ্রসংগীত ঠিক হয়নি।’ এই কথাটি ছেলেবেলা থেকে কত জনের কাছে যে শুনতে হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। যৌবনে ঝুমুরশিল্পী, পরে আকাশবাণীর কর্মী, অবসর নেওয়ার পরে গ্রামোফোন কোম্পানি অব ইন্ডিয়া-র এক উপদেষ্টা ও অফিসার বিমান ঘোষ অনেক কাল আগে আমায় বলেছিলেন যাঁরা শুধু রবীন্দ্রনাথের গানে স্পেশালাইজ করেছেন, তাঁদের জন্য কিন্তু রবীন্দ্রসংগীত বাংলার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েনি। বরং আধুনিক গানের শিল্পীদের গাওয়া রবীন্দ্রনাথের গানই লোকে নিয়েছে বেশি, রেকর্ড বিক্রির হিসেবেও এঁরাই আগুয়ান।
তা হলে কি গ্রামোফোন রেকর্ড বা মিউজিক ক্যাসেট বা আজকের সিডি-র বিক্রির হিসেবে শিল্প ও শিল্পীর বিচার হবে? জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রর গাওয়া রবীন্দ্রনাথের ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে’ গানটির রেকর্ড শুনে কৈশোরেই টের পেয়েছিলাম কোথায় তাঁর আবেদন। এর বহু বছর পর আশা ভোঁসলের কণ্ঠে এই গানেরই রেকর্ডিং শুনে তাক লেগে গেল। প্রতিটি স্বর কী অমোঘ ভাবে লাগাচ্ছেন তিনি! অন্তরায় তারসপ্তকের সা থেকে চকিতে তারের শুদ্ধ মধ্যম ছুঁয়ে আসা হায় হায়। কী অব্যর্থ! শিল্পী যেন শার্প শুটার। রাইফেল তাক করে একটি গুলি চালালেন কী লক্ষ্যভেদ! আশা ভোঁসলে গাইছেন কী আনন্দ করে! সেই আনন্দের উজ্জ্বলতায় স্নান করছি আমি। ‘তোমারি ঝরনাতলার নির্জনে’ গানটি শুনে আমার কট্টর রবীন্দ্রবাদী বাবা, রবীন্দ্রনাথ যাঁকে মাসে পঁচিশ টাকা মাইনেয় সংগীত ভবনে তাঁর কাছে শিক্ষানবিশি করার জন্য চেয়েছিলেন এবং যিনি এতটাই অদূরদর্শী যে অত কম মাইনেয় চলবে না বলে বুলা মহলানবিশকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, সেই সুধীন্দ্রনাথ হইহই করে বলে উঠেছিলেন ওরে, উনি এই মেয়েটার জন্যেই বেঁধেছিলেন রে গানটা। এই মেয়েটা মুক্তি দিয়ে দিল গানটাকে। সত্যিই তাই। অন্তরা থেকে স্থায়ীতে ফিরছেন যে তানটি করে অত নিখুঁত, অত সুরেলা, অত স্বাভাবিক তান তার আগে কোনও দিনই শুনিনি কারওর গলায় এই গানে। হবে না? কী-সব গান গেয়েছেন আশা ভোঁসলে তাঁর পেশা-জীবনে। তিনি পুরোদস্তুর খেয়াল-ঠুংরি শিখেছিলেন। কত বিচিত্র আঙ্গিকের গান গাইতে পারতেন। টেকনিকালি তিনি চোস্তরও বেশি সুপার-চোস্ত। |
|
ছবি: সুমন চৌধুরী |
কিন্তু টেকনিকালি দুর্ধর্ষ হলেই এক জন শিল্পী রবীন্দ্রসংগীত রসোত্তীর্ণ ভাবে গাইতে পারবেন? সংগীতাচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের সঙ্গে এক বেতার-সাক্ষাৎকারে রবীন্দ্রসংগীতের এক বিস্ময় সাহানা দেবী বলেছিলেন, ‘স্বরলিপি দেখে গান হয় না। সুরের ভেতরে যে সুরটি থাকে, সেটা ধরতে পারলে তবেই গান হয়।’ আশা ভোঁসলে স্বরলিপি দেখে রবীন্দ্রনাথের গানগুলি শেখেননি। যত দূর জানি তাঁর ট্রেনার ছিলেন সন্তোষ সেনগুপ্ত। বয়সকালে সন্তোষ সেনগুপ্তও ছিলেন এক দুর্দান্ত গায়ক। তাঁর মতো ট্রেনার পেয়েছিলেন বলে আশা ভোঁসলের রেকর্ডিং ওই মানের হতে পেরেছিল।
কিন্তু জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রর গাওয়া ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে’? আশা ভোঁসলের গাওয়া গানটি শুনে মন ওঠে নেচে। তাঁর কণ্ঠের সুরে রংধনু খেলে যায়। কিন্তু জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র-র গাওয়া একই গানের রেকর্ডটি শুনলে মনে হয় এই মানুষটি বোধ হয় সুরের ভেতরকার সুরটি সন্ধান করছেন। ‘তোমার যজ্ঞে দিয়েছ ভার, বাজাই আমি বাঁশি/ গানে গানে গেঁথে বেড়াই প্রাণের কান্না হাসি’ সেই কোন ছোটবেলায় শুনেছিলাম, শুনে শুনে শিখে নিয়েছিলাম। কত শিল্পীর কণ্ঠে শুনলাম এই গান। আজ, চৌষট্টি পেরিয়ে আপন মনে গুনগুন করে গাইতে গিয়ে বুঝতে পারি শুধু টেকনিকাল উৎকর্ষের বিষয় এটা নয়। ঠিক যেমন আচার্য বড়ে গোলাম আলি খান সাহেবের মতো অবিশ্বাস্য কণ্ঠ-ক্ষমতাধর শিল্পীও ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে’ গানটি আচার্য আব্বাস-উদ্দিনের মতো স্রেফ খুন করে ফেলার মেজাজে গাইতে পারতেন বলে মনে হয় না। অথচ কী সহজ-সরল গান। সুর-তালের জন্মগত ক্ষমতাসম্পন্ন যে-কোনও শিশুও গেয়ে দিতে পারবে। কিন্তু ‘বগারে দেখিয়া বগী কান্দে রে/ বগীরে দেখিয়া বগা কান্দে রে’ একই সুরে এই দুটি উক্তি আজকের বড়, নামজাদা শিল্পীরা করে দেখুন। সম্ভবত দেখতে পাবেন আব্বাস-উদ্দিনের ধারেকাছেও যাচ্ছে না। এই গানের যে আঙ্গিক, তার ভেতরকার সুরটি নিছক টেকনিকালি ধরা সম্ভব নয়। তেমনি, অনেক পুনরাবৃত্ত-কেয়াবাত-প্রিয়তম শিল্পী এসেছেন, আজও হয়তো আসছেন, কিন্তু আচার্য বড়ে গোলাম আলি খান সাহেবের মতো ‘হরি ওম তৎসৎ’ গানটি ঠুংরি আঙ্গিকে আর একবার গাওয়ার কথা কেউ কল্পনাও করতে পারবেন না যদি তাঁরা বাস্তবিকই প্রশিক্ষিত, শিক্ষিত ও রসিক হন। কথার সঙ্গে সুরবিহার ও কারুকাজ মিলিয়ে কল্পনার কোন আশ্চর্য গগনে খানিক বেড়িয়ে নিয়ে ওই যে তিনি ‘হরি ওম’-এর ‘ওম’ ধ্বনিটি লাগাচ্ছেন মধ্যসপ্তকের পঞ্চমে, তার পরেই শুদ্ধ গান্ধার ছুঁয়ে ষড়জে আসছেন যে ভাবে, যে আঙ্গিকে তিনি তা করছেন, তা তিনিই করবেন বলে এই পৃথিবীটা তৈরি হয়েছিল। ভারত দেশটা নেহাত বেরসিকের, বিশেষ করে রাজনৈতিক ভারত, নয়তো পাঁচ-ওয়াক্ত নামাজ পড়া, রোজা রাখা এই ধর্মপ্রাণ মুসলমান শিল্পীর গাওয়া এই একটি গানের রেকর্ডই মুসলিম-বিদ্বেষী হিন্দুত্ববাদীদের মন মেজাজ পালটে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। মুখে সেকুলার আর মনে মনে মুসলিম-বিদ্বেষী যাঁরা আমাদের দেশে, তাঁদের মনটাও বদলে যেতে পারত। তেমনি প্রতিবেশী দুটি দেশে কট্টর ইসলামবাদীদের মুখে ঔদার্যের হাসি ফুটিয়ে তোলার জন্যেও যথেষ্ট ছিল এই গানের রেকর্ড। তা হল না, কারণ যে-কোনও ক্ষেত্রেই কট্টরপন্থীরা মারাত্মক বেরসিক। ‘হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গলায় রবীন্দ্রসংগীতটা ঠিক হয়নি’ এই উক্তির পেছনেও কাজ করে যাচ্ছে বেরসিক এবং সংগীতরসে নিজেকে যেনতেনপ্রকারেণ বঞ্চিত রাখব এই মনোভাব। সেই সঙ্গে বোধহীনতা। ‘রবীন্দ্রসংগীত’ মানে কী? এক বারও কি আমরা নিজেদের প্রশ্ন করি? রবীন্দ্রনাথ সারা জীবনে কত ধরনের গান বেঁধেছেন। সবই কি একই আঙ্গিকের? ‘তুমি খুশি থাক আমার পানে চেয়ে চেয়ে’ আর ‘মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল-মাঝে’ কি একই ধরনের গান? ‘হারে রে রে রে রে, আমায় ছেড়ে দে রে, দে রে’ আর ‘সার্থক জনম আমার’ একই জিনিস? সবার গলায় ও সহজাত গায়কিতে কি রবীন্দ্রনাথের সব গান শুনতে ভাল লাগে? এক বার কল্পনা করুন, সুবিনয় রায় গাইছেন ‘তোমার হল শুরু’ আর ‘চলে যায় মরি হায় বসন্তের দিন’। নিতান্ত এককাট্টা একবগ্গা বেরসিক না হলে একটু ভেবে নিলেই বুঝবেন কী বলতে চাইছি। তেমনি কল্পনা করুন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় রেকর্ড করছেন ‘রাখো রাখো রে’ বা ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে’। জুতসই হচ্ছে না। ভাবুন এক বার ‘দূরে কোথায় দূরে দূরে’ গানটি শান্তিদেব ঘোষের বদলে কিশোর কুমার গাইছেন। মেলাতে অসুবিধে হবে। এ বারে ভাবুন, সত্যজিৎ রায়ের চারুলতা-য় ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে’ গাইছেন শান্তিদেব ঘোষ। কবি অমিয় চক্রবর্তী যতই লিখুন ‘মেলাবেন তিনি মেলাবেন’, এ জিনিস ‘তিনি’ও মেলাতে পারবেন না।
অতীতের শিল্পীরা রবীন্দ্রনাথের গান রেকর্ড করার সময়ে ভেবেচিন্তেই করেছেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত নয়, রবীন্দ্রনাথের যে গানগুলি ভাল খুলতে পারে, যে গানগুলি তাঁর মেজাজ ও গায়নদক্ষতার সঙ্গে মেলে, সেগুলিই রেকর্ড করে গিয়েছেন তিনি। অন্য শিল্পীরাও এর অন্যথা করেননি বড় একটা। |
|
|
|
|
|