রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ১...
বিশ্বাসবাড়ি
সমের বরাক উপত্যকায় ঝাটিংগা রেল স্টেশন। চতুর্দিকে নিশুতি রাত আর চোখবোজা অন্ধকার। লামডিং-শিলচর প্যাসেঞ্জার দুশো কিলোমিটার অবিমিশ্র জঙ্গল পেরোতে লাগিয়ে দিয়েছে দশ ঘণ্টা। জঙ্গলের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া ঠুনকো মাঠে ট্রেনটা দাঁড়ালে বুঝতে পারলাম স্টেশন। আষাঢ়-বর্ষার রাত। নেমেই শুনি, অন্য সমস্ত দিনের মতো সে দিনও, সন্ধে নামতেই, পাহাড়ে পাহাড়ে ঘোষিত হয়েছে কার্ফু। ঘটঘট করে লাইন বদলে ট্রেনটা চলে যেতেই প্ল্যাটফর্মের বাতি দুটো নিভল। তার পর নিভে গেল ডিসট্যান্ট সিগনালটা। কিম্ভূতকিমাকার অন্ধকারে হাতড়ে পাওয়া বেঞ্চে আন্দাজে বসেছি আমরা চার জন। ঝাঁক বেঁধে বিঁধছে মশা। টিনের শেড-এ মাঝে মাঝেই হাতুড়ি পিটছে বৃষ্টি, বনজ অন্ধকারে পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রেখেছে একটা তক্ষকের ডাক।
এ রকম রাত্তিরে চেনা বোধগুলো জায়গারটা জায়গায় থাকে না, জানি। এ রকম রাত্তিরে ঈশ্বরেরও জেগে থাকার দায় থাকে না তেমন। রিফিউজি-কার্ফু-সৈন্য-ডিসট্যান্ট সিগনাল, সব কিছুই যেন বৃষ্টির তোড়ে নাবাল মাটির মতো গলে যায়। কিচ্ছু না থাকার সেই দৈব মুহূর্তটা বুকের গভীরে গেঁথে নেওয়ার জন্য আমি গভীর ভাবে শ্বাস টানি। আর তখনই নাকে আসে যজ্ঞধূমের ঘ্রাণ।
বাদুড়ের ছায়ার চেয়েও আবছা হয়ে র্যাপার মোড়া কেউ এসে বসেছেন দূরের বেঞ্চটায়।
পাখি দেখতে এসেছেন দাদারা?
পাখি?
হ্যা। ওই আপনারা যারে কন ঝাটিংগা বার্ডস। এমন রাতেই পাখিরা আসে। ঠিক যখন বৃষ্টি পড়ছে গুঁড়ি গুঁড়ি, আকাশে চাঁদ নাই, ভিজা-ভিজা ভারী হাওয়া। আগে গাঁয়ে গাঁয়ে জংলিরা আগুন জ্বালত। সেই আগুনে ঝাঁপ খেয়ে পড়ত পাখি। এখন আগুন জ্বালে না। জ্বালা বারণ। গরমেন্টের মানা আছে। সকলে এখানে পাখি দ্যাখতেই আসে।
আপনি?
প্রফুল্ল মণ্ডল। এখানেই ঘর কন ঘর, বাসা কন বাসা। বাড়ি একটা ছিল কোনও কালে, ও পারে, শ্রীহট্ট জেলায়। সাত পুরুষে জাতবোষ্টম, এ সব তাড়া খাওয়া মাইন্ষের গাঁ থেকে গাঁয়ে নামগান করি। চলে যায়।
ছবি: জয়দীপ মিত্র
পাখি দেখেছেন?
‘শোনেন বাবারা। আমার ঠাকুরদার চেয়ে বড় গাহক ও-পারে আর ছিল না কেউ। জ্ঞান হয়ে ইস্তক দেখছি খোলে বোল তুলতে তুলতে ঠাকুরদা মাঠ পেরিয়ে চলেছেন রাজশাহি, চাঁদপুর, বইরশাল। খোলটার নাম ঠাকুরদা রাখেন ‘গোবিন্দ’। বুড়ার লম্বা চুল চুড়ো করে বাঁধা, নাভি তক দাড়ি, আলখাল্লায় সাঁটা শতখানেক মেডেল। মরার সময় গোবিন্দরে আমার হাতে দিয়ে কন এরে দেখিস, এ তোর সন্তান, এরে সুখে রাখিস। বাপ গেছলেন একাত্তরে। যুদ্ধে। মা গেলেন সাতাত্তরে। ফাঁকা ভিটেয় শুধু আমি আর পিসিমা। আর গোবিন্দ। সাতাশিতে পিসিমাও গেলেন। আর পারলাম না। এ পারে চলে এলাম। সাত পুরুষের বোষ্টম ভিটে থেকে গোবিন্দটারে ছিঁড়ে আনতে পারলাম না। রেখে এলাম। আমার সন্তান, বুঝলেন বাবারা, ভিটে সামলায়।
এ পারে এলাম তো, কিন্তু দম আটকে আসে যে। গানে আর প্রাণ নাই যে, গোবিন্দ বাজে না যে। এই জঙ্গল ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে বেবাক পাক খাই। মরেই যেতাম, পাগলই হতাম বা। ঠিক তখনই, বুঝলেন বাবারা, এ রকমই এক বাদলা রাতে, হঠাৎ শুনি গোবিন্দ বাজছে, এ রকমই সেই রাতে চাঁদ নাই, গুঁড়ো গুঁড়ো বৃষ্টি শুধু। উপরে তাকায়ে দেখি, কত কত ডানায় ডানায় গোবিন্দ বাজছে। স্পষ্ট দেখি, জানেন বাবারা, ফেরেস্তার মতো এক বুড়াবাবা চুড়ো করা চুল, জ্যোৎস্নার মতো দাড়ি শতখানেক মেডেল সাঁটা আলখাল্লা গায়ে হেই আকাশপানে ওড়ে। তার মাথার ওপর ওড়ে পাখির ঝাঁক, আর বুড়াবাবার ইঙ্গিতে ইঙ্গিতে কখনও আস্তে, কখনও জোরে পাখা ঝাপটায় আর পাখা ঝাপটায়।
নাম নিই আমি, নাম গাই আমি। গাঁয়ে গাঁয়ে আগুন নেভাই। পাখিরা পুড়বে কেন, বলেন? বুকে ধকধক করে ঠাকুরদার বীজমন্ত্র। ওটা হারিয়ে ফেললে পাখিরা আসবে না যে। শব্দই তো সব, বলেন? গোবিন্দ না বাজলে আকাশটাও যে শ্মশান হয়, না কি?’
প্রিয় পাঠক, মাঝরাতের এই মেলোড্রামায় সংলাপের একটি শব্দও, অন্ধকারের একটুখানি নাটুকে শেড-ও আমার কল্পনাপ্রসূত নয়। আমরা যারা সারা বছর ভেসে বেড়াই ঘাটে-আঘাটায়, আধাভৌতিক কোনও ছেঁদো গপ্পো ফেঁদে বসার প্রয়োজন তাদের নেই। এ দেশে খাট্টামিঠা যে কোনও চরম অদূরদর্শী ঘটনাতেও অতি সাবলীল ভাবে মিশে থাকে অবাস্তবের উপাদান। ঐতিহ্যগত ভাবেই আমরা বড় বিশ্বাসী মানুষ desperate believers. আজন্ম বেদ-বাৎস্যায়ন-মারী-মন্বন্তর-দাঙ্গা-দেশভাগে লালিত আমাদের বিশ্বাসটুকুই আমাদের জীবনে সুসময় আনে। বিশ্বাস করা এই ইমেজগুলোকে এলোমেলো সাজিয়ে আমরা মন্তাজের মতো এক দৃশ্যরূপ খাড়া করি। আর সেই বিমূর্ত পর্দায় আমরা চিরকাল হামলে বেঁচে থাকি।
এই তো দিন কয়েক আগেই পড়লাম এক মার্কিন গুণী আমাদের, অর্থাৎ ভারতীয়দের সম্বন্ধে লিখছেন 'people of a never, never land. আমরা নাকি এমন এক দেশের নাগরিক, যে দেশটা ছিল না কখনও। দুই মহাকাব্যের অজস্র ভৌতিক-আধাদৈবিক চরিত্রের প্রতি আস্থা রেখে আমরা দেশের এক অনুমান-নির্ভর সংজ্ঞা তৈরি করেছি। সেই জন্যই আমাদের ইতিহাসচেতনা নেই, সুঠাম সমাজের ধারণাটুকুও নেই। অর্থনীতি, অন্তত এতাবৎ কাল পর্যন্ত, ঝাড় খাওয়া, বার্ষিক দুই-তিন শতাংশ বৃদ্ধিকে এই সে দিনও ওরা বাঁকা হাসি হেসে বলেছে ‘Hindu rate of growth.’ আধাবাস্তব দুনিয়ার বাসিন্দা হওয়ায় আমাদের পুরুষকারের অভাব, আমরা নিদারুণ ভাবেই নিয়তিবাদী। আর আমাদের এই চরিত্র জানতেন বলেই প্রতিষ্ঠিত জননায়কেরা বুদ্ধ থেকে গাঁধী পর্যন্ত আজীবন দারিদ্রের উপাসনা করেছেন। নিজেরা পারিনি বলেই আমরা অতি আবেগে আমাদের আইডল দেবতাদের বাধ্য করেছি to leave gigantic foot-marks on hard rock.
উত্তরটাও অনেকেই দিয়েছেন, বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় হ্যারো-কেমব্রিজের ডেঁপো পরিবেশে লালিত পণ্ডিত নেহরুও হিংস্র ভাবেই দিয়েছেন। বাপু হে, আবেগের তোমরা জানোটা কী? মনের মধ্যে, মনের মতো করে, কখনও দেবতাকে গড়েছ কি? তোমরা তো মানুষের মাপে, এক্কেবারে মানুষের মতো করেই, এমনকী তার গোপন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের শিরা-উপশিরার ডিটেল সহ, দেবতাদের এঁকে রেখেছ গির্জার দেওয়ালে। মানুষের চারি দিকে, মানুষ ব্যতিরেকে, আর কিছু চিনেছ কি? তাই তোমাদের নেই কৃষ্ণের আয়ত চোখ, নেই নবজলধরশ্যাম গাত্রবর্ণ। আর erotica? যা সভ্যতার সাবালকত্বের শ্রেষ্ঠ সূচক? মনে রেখো, আমাদের রাধা কবিকল্পনা ছাড়া আর কিছু নন। আর আজ এই গোঁড়া সনাতন সমাজে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা দ্যাখো। তুমি স্তব্ধ বলছ? অচল ও অসাড় বলছ? আমাদের? মনে রেখো, আমাদের প্রত্যেকটি মানুষের একান্ত নিজস্ব সুখ, দুঃখ, ভিটেমাটি, ভালবাসা, খিদে ও অসহায়তা যে ব্যক্তিগত ঈশ্বরের জন্ম দেয়, তাঁরা সবাই হাতে হাত ধরে তৈরি করেন এক ঐশী গণ্ডি। এই গণ্ডিটাকেই আমরা দেশ বলে ভাবি। প্রফুল্ল মণ্ডলের পাখি ও ফেরেস্তা এই গণ্ডির অসীম সংখ্যক defining point-এর মধ্যে একটি। এ তো নেহাতই মানুষের গল্প। হাহাকারের গল্প। এই গল্পকে চূড়ান্ত ঈশ্বরযোগ্যতা দিতে পারো তুমি? প্রফুল্ল মণ্ডল পারে। কারণ, সে বিশ্বাস করতে শিখেছে।
প্রতিটি মানুষের পাপ-পুণ্য সংক্রান্ত এক বিশ্বাসজনিত সংস্কার এই দেশটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ধর্মটর্ম এখানে খুব গৌণ ব্যাপার। একশো তিরিশ কোটির এই বৃহত্তম গণতন্ত্রে অশ্লীল দারিদ্র, ক্লেদাক্ত শ্রেণি-বিভাজন, অন্ধ ঔদাসীন্য দেখতে দেখতে আর চাখতে চাখতে আমাদের বড় বেশি দিন বেঁচে থাকার কথা ছিল না। তবু অনিবার্য এক হননবিলাসী ইতিহাসের সামনে রুখে দাঁড়াল পদাবলি কীর্তন। কোন জাদুতে? গ্ল্যাডিয়েটর ও সিংহের লড়াইয়ে একটা সম্ভাব্য পরিণতি থাকে মৃত্যু। কিন্তু লড়াইটা যদি আদৌ না হয়? যদি আক্রমণের প্রাক্মুহূর্তে দুই প্রতিপক্ষের নাকে ভেসে আসে চরাচর মথিত করা যজ্ঞধূমের ঘ্রাণ? বুকের মধ্যে আয়ত চোখ আরও দুটো দিন দেখতে পাবে বলে যদি সিংহ ও গ্ল্যাডিয়েটর সোজা ফিরে যায় খাঁচায় ও সংসারে, তাকে কি কাপুরুষতা বলব? ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে দুটো বাড়তি দিন সংকোচে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটুকুই কি জীবনের শ্রেষ্ঠ লিরিক নয়?
এই জীবনবোধ থেকেই আমরা ঈশ্বর গড়েছি নশ্বর মাটিতে। হ্যাঁ, যদি বলেন তবে তাই নির্লজ্জ ভাবেই গড়েছি। যুক্তি ব্যতিরেকেই গড়েছি। মথুরায় ৬ ফুট বাই ৮ ফুট অন্ধকার কুঠুরিতে এক বিশ্বাসী মানুষ যখন আমাকে বলেন, ঠিক ওই জায়গাটায় আজ থেকে ৫২২৬ বছর ৭ মাস ২১ দিন আগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল, তখন এক মুহূর্তের জন্যেও তাঁকে আমি অবিশ্বাস করিনি, কারণ তাঁর বিশ্বাস তাঁকে তেমনই নিঃসংশয় করেছে। বৃন্দাবনের ভজনাশ্রমে তাবৎ ছেলে-তাড়ানো, বউমা-খেদানো অনাথা বাঙালি বিধবাদের বাস। তাঁদের রুটি-রুজি-দিন-মান চব্বিশ ঘণ্টাই ঘুরপাক খায় যুগল-মুরতি ঘিরে। নোনা-ধরা দেওয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে আমি দিনের পর দিন পুতুলের মাপের খাটে পুতুলের মাপের বিছানায় রাইরাজা ও রাধারানিকে ঘুম পাড়ানোর ব্যস্ত আবেগ দেখেছি। ওই সময়টায় খুব উলুধ্বনি হয়, খোল ও করতাল বাজে, ধূপ পোড়ে, চামর দোলে। গোটা প্রক্রিয়ায় সামান্যতম অসংগতিও আমার চোখে কখনও পড়েনি। বরং সুদূর বাংলায় কিন্ডারগার্টেনে পড়া একলা খাটে শোওয়া একলা ভয় পাওয়া অনেক বালক-বালিকার মুখ মনে এসেছে। অবদমিত স্নেহ কোথায় বীজ বোনে আর কোথায় রোপণ করে তা নিশ্চয়ই রাইরাজা জানেন। আমরা নিমিত্ত মাত্র rank observers ঈশ্বরের মানবলীলা তো বড় সহজ কথা নয়। অপ্রেমের শূন্যতাটুকু যদি ঈশ্বর বুজিয়ে দেন, ক্ষতি কার?
চোরাবালির মতো এক নিয়তি-নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে আমাদের বাস। এই ভূখণ্ডকে আমরা দেশ বলে জানি। প্রেমে ও প্লাবনে থই-থই এক বন্যার ল্যান্ডস্কেপে আমাদের বাস। দুঃস্থের সেই দুঃখবোধকেও আমরা দেশ বলে জানি। আত্মমগ্ন একশো তিরিশ কোটি মানুষের পিঠে কর্কশ রোদ্দুর। সর্বংসহা সেই মৌনী মিছিলকেও আমরা দেশ বলে জানি। এই দেশে প্রেম বিনা প্রাণ নাই। কানু বিনা গীতও নাই।
ওড়িশার চন্দ্রগিরিতে তিব্বতি রিফিউজি ক্যাম্পে যাবার সময় বাস আমাকে এক খোলা মাঠে নামিয়ে দিয়ে চলে যায়। শেষ বৈশাখে পাহাড়ে-পাহাড়ে গনগন করছে কৃষ্ণচূড়া। প্রথমেই কানে এল প্রার্থনা-পতাকার ছটফটানি, যাকে বলে flutter। মন্ত্রলেখা নিশান ছুঁয়ে বাতাস চতুর্দিকে বয়ে গিয়ে ঠেকিয়ে রাখে নেতি-পৃথিবীকে। তিব্বতিদের তাই বিশ্বাস।
জোটপ্রবণতা যদি হয় রিফিউজির টিকে থাকার চাবিকাঠি, তবে সমবায়স্থাপন নিঃসন্দেহে তার প্রাচুর্যের ব্যাকরণ। তিব্বতি শরণার্থীরা সমবায় গেস্ট হাউস চালায়, ট্রাক্টর ভাড়া দেয়, মেম্বারদের রিকুইজিশন অনুযায়ী ত্রিপিটক পাঠের জন্য বাড়িতে লামা পাঠায়, ক্রেশ চালায়, নুড্লস বানায়, সোয়েটার ও কার্পেট বোনে, তেমন প্রয়োজনে হাতিও পোষে। ফলত রাস্তাঘাটে, স্তূপে, বাগানে সুস্মিত, সুখী মুখের মিছিল। তবে কি তাবৎ সুখের পিছনে মিলিজুলি সমবণ্টন? এতে ঈশ্বরের কোনও ভূমিকাই নেই?
পাকা খবর নিয়ে ঠিক বিকেল চারটেয় চলে এলাম লোবারসিং গ্রামের প্রাচীন গুম্ফায়। এর দরজা প্রতি দিন খোলে না, কিন্তু সে দিন খুলল। শাঁখ বাজাতে বাজাতে দরজা খুললেন তিন সন্ন্যাসিনী। কপাটের ও পারে কাচের শো-কেসে পদ্মাসনে বসে আছেন কেউ। ইনি এক জন রিমপোচে, বা জ্ঞানী। ইভ্যাকুয়েশনের বহু আগে ইনি পৃথিবীর মায়া কাটিয়েছেন। ধ্যানমগ্ন শরীরটা মমি করে লুকোনো ছিল তিব্বতের কোনও মনাস্ট্রির গোপন কোটরে। চিরতরে চলে আসার সময় শরণার্থীরা দোলায় চাপিয়ে সেই পবিত্র স্মারক নিয়ে আসে এই উপত্যকায়। সেই থেকে এই উপত্যকার যাবতীয় দায় এঁরই।
মেয়েলি মন্ত্রের জোর সপ্তমে চড়লে এক মুঠো মন্ত্রপূত চাল দরজা পেরিয়ে ঠিকরে পড়ে আমার শরীরে। আর ঠিক তক্ষুনি আসে বছরের প্রথম কালবৈশাখী। হাওয়ার তোড়ে আকাশ লাল করে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যায় কৃষ্ণচূড়া। আর ধুলোর আড়াল নিয়ে এই সমবায় উপত্যকায় এক মুঠো আশ্রয়ের বীজ ছুড়ে দেন চিরসখা। হ্যাঁ, পৃথিবীর সুসময় বেয়ে আমরা এত, এত মানুষ প্রতি দিন স্পষ্ট দেখি মমির চোখে দিব্যদৃষ্টি।
কেরলের কাসরগড় জেলার এক সমৃদ্ধ গ্রামে আদনানের মুখোমুখি হই। অঞ্চলটা সিপিএম-এর দুর্গই বলা চলে। আদনানের বাড়ির দেওয়ালেই রক্তিম কাস্তে-হাতুড়ি দুপুর-রোদে চোখ ঝলসে দিচ্ছিল। আদনান হিন্দি-ইংরেজি একেবারেই জানেন না। বামঘেঁষা মননের প্রতি তাঁর নিশ্চিত মোহের কথা ডাক্তারি-ছাত্র ভাইপোর মাধ্যমে বার বার আমাদের জানান। তাঁকে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, বস্তুবাদী এক ভাবাদর্শে বিশ্বাস রাখা এই মানুষটা থেইয়াম-এর মতো এক নাচের ডাকসাইটে নর্তক?
অন্য কোনও নাচ হলে কথা ছিল না, কিন্তু থেইয়াম সাধারণ নাচ নয়। সেই অর্থে থেইয়াম কোনও নাচই নয়, বরং সংস্কার বলাই ভাল। উত্তর কেরলের প্রায় প্রতিটি গ্রামের মন্দিরে বছরে এক বার থেইয়াম-এর আসর বসে। সারা শরীরে অতিলৌকিক নকশা আঁকা থেইয়াম-শিল্পী সেই আসরে দেবতার ভূমিকা নিয়ে সমাজের ওপর কুদৃষ্টি-হানা সমস্ত অপ-উপসর্গকে চ্যালেঞ্জ করেন। মানুষ মোহিত হয়, আশ্বস্ত হয় শিল্পীর ওপর দেবতাকে ভর করতে দেখে। অর্থাৎ আদনান, প্রকৃত অর্থে, নর্তক তো বটেই, মাধ্যমও। রাজনৈতিক ভাবে বেঠিক এক পরাপৃথিবীকে ভাবচক্ষুতে দেখতে না পেলে থেইয়াম নাচা যায় না।
মন্দিরের সামনে বিশাল খোলা জায়গাটায় পড়ন্ত বিকেলে ঘাসের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লেন আদনান। নারকেলের মালায় রাখা রঙে তুলি ডুবিয়ে তাঁর মুখে, নাকে, চোখের পাতায় সাহসী উল্কি এঁকে চললেন এক বৃদ্ধ। কয়েকটা ছোকরা বয়ে নিয়ে এল দানবের মাপের সব অঙ্গসজ্জা। বাচ্চারা দল বেঁধে মন্দিরের সর্বত্র বসিয়ে দিচ্ছে প্রদীপ। জানতে পারলাম, আদনান ওই রাতে চামুণ্ডা হবেন।
ঘণ্টা তিনেক পরে, খোলা মাঠে দাউদাউ জ্বলছে আগুন, আদনানকে দাঁড় করিয়ে তাঁর কোমরে বাঁধা হল ছ’টা মশাল। মশালগুলো জ্বলে উঠল। বৃদ্ধ আঁকিয়ে আদনানের হাতে একটা আয়না ধরিয়ে দিয়ে দূরে সরে গেলেন। আগুনজ্বলা, প্রাকৃত রাত্রির সমস্ত ফোকাসটুকু টেনে নিয়ে আদনান মুখ দেখছেন আয়নায়। মায়াদর্পণে চামুণ্ডার চোখ দুটো আমি ক্রমশ প্রচণ্ড হয়ে উঠতে দেখি। আদনান আর আদনানে নেই। তাঁর শরীর ঢেউ হয়ে যাচ্ছে ভৌতিক কম্পনে। চরম মুহূর্তে তাঁর হাত থেকে ছিটকে গেল আয়না। চামুণ্ডা তরোয়াল বাগিয়ে ধরলেন। তার পর হুহুংকারে, আগুন ডিঙিয়ে, এক মন্ত্রপূত গাছ পর্যন্ত দৌড়ে গেলেন। গাছতলায় বাঁধা একটা মোরগ। চোখের পলক ফেলার আগে চামুণ্ডা জ্যান্ত মোরগটার গলা ছিঁড়ে নিলেন। আর তৃষ্ণার্তের মতো পান করলেন সমস্ত রক্তটুকু। সমবেত ভিড়ের মধ্যে থেকে গোঙানির মতো এক অনুমোদনসূচক ধ্বনি। চামুণ্ডা গ্রহণ করেছেন গ্রামের ভেট। তার পর অনেক ঘণ্টা ধরে সন্ধানী, ভয়ঙ্কর চোখ মন্দিরের আনাচেকানাচে রেখে চামুণ্ডা দৌড়ে বেড়ালেন আর দৌড়ে বেড়ালেন, কত নিযুত বার যে বাতাস খণ্ডিত হল তার তরোয়ালে, হিসেব রাখিনি। তাঁর কষে রক্তের দাগ অত ঘণ্টা ধরেই দগদগে থেকে গেল।
খুব নিশ্চিত ভাবেই জানি, ওই রক্তে আঙুল ডুবিয়ে তাঁর বাড়ির দেওয়ালে ছোট্ট ছোট্ট কাস্তে-হাতুড়ির ছবি আঁকতে বললে আদনান বড় সুখী হতেন। বিশ্বাসের ম্যানিফেস্টো কমরেড আদনানের ধর্মের অতি পোক্ত ভিত।
আরামবাগের কাছে বাতানল গ্রাম। চৈত্র সংক্রান্তির দিন সকাল আটটাতেই রোদ চড়ে আছে। পোস্টে পোস্টে বাঁধা চোঙায় গাজনের গান বিকৃত বাজছে। গ্রামের একরত্তি শিবমন্দিরের বাইরে অগোছালো জনসমাবেশ। মন্দিরের চাতালে বসে জন পঞ্চাশেক গাজন-সন্ন্যাসী। পরনে রক্তাম্বর, অর্থাৎ, লাল গামছা। বৃদ্ধ পুরোহিত মাঝে মাঝেই কলসি কলসি জল ঢেলে ভিজিয়ে দিচ্ছেন সবাইকে। মন্দিরের ভিতর ক্ষেপণাস্ত্র প্রদর্শনীর ঢঙে রাখা অজস্র গজাল, বর্শা, গুণছুঁচ, কয়েকটা হাতুড়িও।
ভিড়ের ভিতর দিয়ে অনেকগুলো সাইকেল ভ্যানকে মন্দিরের চত্বরে আসতে দেখা গেল। প্রত্যেকটা ভ্যানে খাড়া করা আছে এক একটা প্রমাণ আকারের কাঠের ক্রুশ। ক্রুশগুলোর প্রান্ত থেকে গাঁদা ফুলের মালা ঝুলছে। পুরোহিতের ইঙ্গিতে চড়ক সন্ন্যাসীরা উঠে দাঁড়ালেন। তার পর ‘জয় বাবা তারকনাথ’ হুংকার ছেড়ে উঠতে থাকলেন ভ্যানগুলোয়। প্রতি ভ্যানে দুজন। ভিড়ের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে দুজন মহিলা ছুড়তে থাকলেন মুঠো মুঠো বাতাসা।
সমবেত হুড়োহুড়ির মধ্যে প্রতিটি ভ্যানের প্রতিটি ক্রুশের এ পিঠে-ও পিঠে পিঠোপিঠি দাঁড়ালেন জোড়ায় জোড়ায় চড়ক সন্ন্যাসী। তার পর ক্রুশের আড়াআড়ি কাঠটা বরাবর দু’হাত মেলে দিলেন। হেল্পারের দল প্রত্যেক সন্ন্যাসীর কোমর ও দুই হাত শক্ত করে বাঁধল ক্রুশের সঙ্গে। তার পরই বিড়ালের নমনীয়তায়, ছোট্ট লাফে, প্রথম ভ্যানটায় উঠে পড়লেন অশীতিপর পুরোহিত। হাতে হাতুড়ি। তার সহকারীর মুঠোভর্তি হিংস্র গজাল।
বজ্রপাতের ঘাত-ক্ষমতা নিয়ে প্রথম গজালটায় হাতুড়ির ঘা পড়ল। তার পর দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, আরও আরও গজাল, সন্ন্যাসীর হাতের-পেটের মাংস-চামড়া ফুঁড়ে গজালগুলো আমূল গেঁথে যাচ্ছে ক্রুশের কাঠে। তাঁর সমস্ত শরীর বেঁকে যাচ্ছে রামধনুর মতো, দুই চোখে জল ঝরছে স্রোতের মতো। তাঁর দৃষ্টি আড়াল করে রেখেছে হেল্পারের দয়ালু বরাভয়।
দু’ঘণ্টা ধরে পঁচিশটা সাইকেল ভ্যানে পিঠোপিঠি ক্রুশবিদ্ধ হন পঞ্চাশ জন চড়ক সন্ন্যাসী। এঁরা এই গ্রামেরই সুকুমার, সহদেব, সুবিমল। ভ্যানগুলো অবশেষে সারি দিয়ে বেরিয়ে পড়ল গ্রামের রাস্তায়। আবেগমথিত আমজনতার মাথার ওপর দিয়ে ভেসে ভেসে চললেন পঞ্চাশ জন মসিহা। গতির কারণে, কিংবা চৈতি হাওয়ায়, ক্রুশে ঝোলানো মালাগুলো তখনও ঝুলছে। এ বাতাস নিশ্চয়ই সুবাতাস।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.