|
|
|
|
৭০০ কোটি হাতিয়ে আমেরিকায় |
জমিকে কুমিরছানা করে ব্যাঙ্ক-জালিয়াতি
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
আবার সেই কুমিরছানার গল্প চুরি করে প্রতারণা! এবং চিত্রনাট্যে যেন সুদীপ্ত সেনের সারদা কাণ্ডের এক খাবলা আর ইন্দ্রজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের ব্যাঙ্ক-জালিয়াতির এক খাবলা মিশেল!
কুমিরছানা এখানে একটি জমি। সেই সবে ধন জমিটি একাধিক জায়গায় দেখিয়ে টাকা হাতানো হয়েছে। সম্ভ্রম জাগাতে দেখানো হয়েছে প্রচুর ভুয়ো সংস্থাও। এ ভাবে প্রতারণা করে কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাঙ্ক থেকে আত্মসাৎ করা হয়েছে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা।
তদন্তে নেমে সিবিআই জেনেছে, কয়েক বছর ধরে কলকাতা-সহ দেশের নানা প্রান্তে কয়েকটি ব্যাঙ্ককে বোকা
|
অভিযুক্ত
পুষ্পেশ বৈদ্য |
বানিয়ে ওই টাকা নিয়ে হাওয়া হয়ে গিয়েছেন পুষ্পেশ বৈদ্য নামে এক যুবক। ২০১২ সালের জুলাইয়ে অভিযোগ পাওয়ার পর থেকে তাঁর হদিস নেই। গোয়েন্দাদের খবর, নিউ আলিপুরের এক বান্ধবীকে নিয়ে পুষ্পেশ আছেন আমেরিকায়। অন্যতম অভিযুক্ত পুষ্পেশের বাবা প্রেমপ্রকাশ বৈদ্য এবং মা কোকিলাদেবী রয়েছেন নেপালে। তিন জনের নামেই ‘লুক-আউট নোটিস’ (বন্দর, বিমানবন্দরের মতো জায়গায় নজরদারি) জারি করা হয়েছে। পুষ্পেশের বিরুদ্ধে ‘রেড কর্নার নোটিস’ (বিদেশে গা-ঢাকা দেওয়া অভিযুক্তকে ধরতে পরোয়ানা) জারি করার জন্য ইতিমধ্যেই আর্জি জানানো হয়েছে ইন্টারপোলকে।
গোয়েন্দা সূত্র জানাচ্ছে, বছর দুয়েক আগে হাওড়ায় স্টেট ব্যাঙ্কের একটি বাণিজ্যিক শাখা থেকে প্রায় ২৫ কোটি টাকা ঋণ নেন পুষ্পেশ। তার জন্য একবালপুরে নিজের ও মায়ের নামে থাকা ২০ কাঠা জমি বন্ধক রাখেন ব্যাঙ্কে। তার পরে দু’-একটি কিস্তির টাকা দিয়ে আর ঋণ শোধ করেননি। ২০১২ সালে ব্যাঙ্কের নতুন ম্যানেজার এসে টাকা আদায়ের জন্য ওই জমি দেখতে গিয়ে হতবাক হয়ে যান। তিনি দেখেন, বন্ধক রাখা জমিতে ঝুলছে অন্য একটি কারখানার সাইনবোর্ড। জানা যায়, মোটা টাকায় ওই কারখানার কর্তৃপক্ষের কাছে জমিটি বেচেছেন পুষ্পেশ। জগাছা থানায় প্রতারণার অভিযোগ দায়ের করেন ব্যাঙ্ক ম্যানেজার। তদন্তে নেমে সিবিআই দেখে, দেশের বিভিন্ন শহরে নানা ব্যাঙ্কে এ ভাবেই জমি বন্ধক রেখে টাকা হাতিয়েছেন ওই যুবক। তার মধ্যে স্টেট ব্যাঙ্কের বালিগঞ্জ ও ভবানীপুরের বাণিজ্যিক শাখাও রয়েছে। স্টেট ব্যাঙ্কের অন্য একটি শাখা থেকে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার ঋণ নিশ্চিত করে ফেলেছিলেন পুষ্পেশ। কিন্তু হাওড়া শাখার জালিয়াতি ধরা পড়ার
পরে শেষ পর্যন্ত সেই টাকা আর হাতাতে পারেননি।
জালিয়াতি করা হত কী ভাবে?
সিবিআই সূত্রের খবর, একবালপুরের জমি এবং শেক্সপিয়র সরণি ও চৌরঙ্গিতে নিজেদের কয়েকটি ফ্ল্যাটের একাধিক ভুয়ো দলিল বানিয়েছিলেন পুষ্পেশ। সেগুলি দেখিয়েই বিভিন্ন ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নেন। একই জমি বা ফ্ল্যাট একাধিক ব্যাঙ্কে বন্ধক রাখতেন তিনি। নিজের ব্যবসায়ী পরিচয় তৈরির জন্য প্রচুর ভুয়ো সংস্থাও খুলেছিলেন পুষ্পেশ। এক সিবিআই-কর্তা বলেন, “খাতায়-কলমে পুষ্পেশ অন্তত ১৫৩টি সংস্থার ডিরেক্টর ছিলেন।” ওই কর্তার দাবি, সেই সব সংস্থার বেশির ভাগই কাপড়ের ব্যবসা করে বলে দেখানো হয়েছিল। ব্যাঙ্কের সঙ্গে প্রতারণা করে ইন্দ্রজিৎ চট্টোপাধ্যায় এখন জেলে। পুষ্পেশ বিভিন্ন ব্যাঙ্ককে নিশানা বানিয়েছিলেন অনেকটা তাঁরই কায়দায়। আবার হরেক কিসিমের সংস্থা দেখিয়ে সারদা-কর্ণধার সুদীপ্ত যে-ভাবে কোটি
কোটি টাকা সংগ্রহ করেছিলেন,
সেই পথেও প্রতারণার জাল বিছিয়েছিলেন পুষ্পেশ।
তদন্তকারীরা জানান, পুষ্পেশের ঠাকুরদার বস্ত্র কারখানা রয়েছে তামিলনাড়ুতে। হোসিয়ারি সামগ্রীর ব্যবসা করতেন প্রেমপ্রকাশও। উত্তর ভারতের বিভিন্ন জায়গায় তাঁর পণ্য বিক্রি হত। লাভ হত ভালই। আদতে রাজস্থানের বাসিন্দা বৈদ্য পরিবার বড়বাজারে থাকত। আর্থিক অবস্থার উন্নতি হওয়ায় শেক্সপিয়র সরণির উচ্চবিত্ত এলাকায় চলে যায় তারা। নামে গয়নার ব্যবসাতেও।
কিন্তু ব্যাঙ্ক কী ভাবে পুষ্পেশের ফাঁদে পা দিল? বন্ধক রেখে ঋণ দেওয়ার সময় তারা কি নথিপত্র খতিয়ে দেখে না?
সিবিআই-কর্তারা বলছেন, এ-সব ক্ষেত্রে নথিপত্র যাচাই করাটাই দস্তুর। কিন্তু অনেক ব্যাঙ্ককর্তার সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল পুষ্পেশের। ঠিক যে-ভাবে ব্যাঙ্ক অফিসারদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুলেছিলেন ইন্দ্রজিৎও। এক শ্রেণির ব্যাঙ্ককর্তাই পুষ্পেশকে ঋণ পাইয়ে দিতে সহায়তা করেছেন বলে জেনেছে সিবিআই। উপঢৌকন পেতেন তাঁরা। এক তদন্তকারী অফিসার বলেন, “রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ে বৈদ্যুতিন সরঞ্জামের শো-রুম ছিল বৈদ্য পরিবারের। সেখান থেকে বৈদ্যুতিন পণ্য পাঠানো হত কিছু ব্যাঙ্ককর্তার কাছে। এর তথ্যপ্রমাণ মিলেছে। সব কিছুর উপরেই নজর রাখা হচ্ছে।” তদন্তে কলকাতার একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের প্রাক্তন চিফ জেনারেল ম্যানেজারের নামও উঠে এসেছে। |
|
|
|
|
|