|
|
|
|
|
|
|
হাঁড়ির খবর |
ভাজা মাছটি উল্টে খান
ঋজু বসু |
|
যতই দেশ-বিদেশের খানার ফিউশন-চর্চায় মেতে থাকুন, প্রদীপ রোজারিও-র মধ্যে একটা নাছোড়বান্দা
বাঙালিয়ানা আছে।
স্বভূমির পাশে কেকে’জ ফিউশন থেকে বেরিয়ে গাড়ি ছুটিয়ে বাগুইআটি কি রুবি হাসপাতালের পাড়ার মাছ-বাজারে ‘সান্ধ্য-ফসল’-এর সামনে তিনি কদাচিত্ নিজেকে সামলাতে পারবেন। রাশি রাশি পাবদা-ট্যাংরা কি মৌরলা গাড়িতে তুলে বাঁধা মেনুর ছক ভেঙে নতুন একটা কী-র ফন্দি আঁটতে আঁটতে সত্বর কিচেনে ফিরবেন। সে দিন হয়তো অতিথিদের টেবিলে টেবিলে লোভ দেখানো হল, বাঙালির চেনা নানা কিসিমের মাছ দিয়ে ঝটপট নামানো এক মিলিমিশি স্প্যানিশ পায়েয়ার। চিজ-অলিভ অয়েলের সুঘ্রাণে সেই মাছভাত এক অন্য মাত্রা পেল।
এ হেন প্রদীপ রোজারিও যে ম্যাঙ্গালোরের খটোমটো নামের গাঁয়ে বন্ধুর বাড়িতে তাঁর মায়ের রান্না লাল টকটকে ঝাল-ঝাল সুরমাই-পমফ্রেট ফ্রাই খেতে খেতে সরপুঁটি, তেলাপিয়ার কথা ভাববেন, এতে আশ্চর্যের কী আছে! তাঁর ম্যাঙ্গালোরের বন্ধু সুরেশ ভাণ্ডারীর মা কুসুমাদেবী চিংড়ির শুঁটকিও বেড়ে রাঁধেন। ওদের শুঁটকি আমাদের মতো মাখো-মাখো নয়, শুকনো। কচকচে পেঁয়াজ-লঙ্কায় নেড়ে পাতে আসে। খেতে খেতে প্রদীপ ভাবেন, ইস্, এটা গাঙমৌরলা হলে জমে যেত মাইরি! |
|
অতএব কলকাতার কেকে’জ ফিউশনে সম্প্রতি তাঁর হাতে নতুন নতুন এক্সপেরিমেন্টের দরজা যে খুলে যাবে, এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। ম্যাঙ্গালোরে প্রদীপের বন্ধুর মায়ের রান্না খেতে যাওয়া অবশ্য বিশেষ উদ্দেশ্যে। মুম্বইয়ের কোলাবায় সদ্য কারি ক্লাবের নতুন সংস্করণ খুলেছেন প্রদীপ। তাতে ম্যাঙ্গালোর-সহ পশ্চিম উপকূলের জয়জয়কার। সেই প্রেরণাতেই কলকাতাতেও ম্যাঙ্গালোরকে প্রতিষ্ঠায় মেতেছেন তিনি।
বাঙালির বৌমা ঐশ্বর্য রাইয়ের বাপের বাড়ির দেশ ম্যাঙ্গালোরও যে বাঙালির মতোই ঘোর মেছো, সে খবর আমরা ক’জন রাখি! অ্যাদ্দিন কলকাতায় পোর্তো রিও, সিনামনের মতো কত মহারথী রেস্তোরাঁ মুছে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের দুরন্ত ভেটকি রাওয়া ফ্রাইয়ের শোকে আমাদের দীর্ঘশ্বাস পড়েছে। চেনা ফিশ ফ্রাই, ফিঙ্গার যতই ভাল হোক, মাঝেমধ্যে তো একটু একঘেয়েও লাগে! রাওয়া বা সুজিতে মোড়া ব্যাটারে ক্যালকাটা ভেটকি যে কী দারুণ খোলে তা না খেলে বিশ্বাস হবে না। হাতে সবেধন নীলমণি চারকোল গ্রিল গত কয়েক বছর ধরে এই শহরে রাওয়া ফ্রাইয়ের একমাত্র রচয়িতা বলে টিকে থেকেছে। শুধু ভেটকি নয়, বম্বে ডাক বা বাঙালির হদ্দ চেনা পাতি লইট্যা মাছের রাওয়া ফ্রাইতেও তারা সিদ্ধহস্ত। এ বার প্রদীপের কে কে’জ ফিউশন সেই লইট্যা-গৌরবে ভাগ বসাল। চারকোল গ্রিলে তিন ধরনের লইট্যা ভাজা হয়। হাল্কা নামমাত্র ব্যাটারে স্বাভাবিক মাছভাজা, রাওয়া ফ্রাই ও পেটে চিংড়িঠাসা লইট্যা-ভাজা। এখন কিছু দিন দিঘা-আন্দামানে সমুদ্রে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার ফলে তাদের স্টক শেষ। বম্বে ডাকের জন্য অতএব আরও হপ্তাখানেক হয়তো কলকাতায় অপেক্ষা
করতে হবে।
এই দুর্যোগে প্রদীপ কিন্তু হাল ছেড়ে বসে থাকার পাত্র নন। বম্বে ডাকের অভাব মেটাতে বাঙালির বেলেকে বেছে নিয়েছেন তিনি। বেলে মাছের নিজস্ব স্বাদ বলতে কিস্যু নেই। পনিরের মতো ম্যারিনেশনের স্বাদ আহরণ করেই সে সমৃদ্ধ। প্রদীপ বেলের কাঁটা ছাড়িয়ে ম্যাঙ্গালোর-স্টাইলে নারকোল, শুকনো লঙ্কা, রসুনের একটা পেস্টে মাছটা এক ঘণ্টাখানেক ম্যারিনেট করেছেন। তার পরে সারা গায়ে সুজি লেপে সাদা তেলে ভাজা হচ্ছে। চারকোল গ্রিলের শেফ শুভেন্দু মাইতি রাওয়া ফ্রাইয়ের ব্যাটারে সামান্য ডিম দেন। প্রদীপের সেটা পছন্দ নয়। লইট্যা-ভেটকি থেকে বেলে-চিংড়ি-তোপসে কত ভাবেই যে রাওয়া ফ্রাই হতে পারে। হুইস্কির রাজযোটক, বলাই বাহুল্য।
শুধু কি রাওয়া ফ্রাই? একটু বড় সাইজের ট্যাংরাকেও তরিবত করে বোনলেস করে অন্য স্টাইলে ভাজা হচ্ছে। মোটা ব্যাটার তাতে ময়দার সঙ্গে জলের বদলে নারকোলের দুধ। দু’কাপ ময়দায় এক কাপ নারকোলের দুধ। বোনলেস ট্যাংরার ম্যারিনেশনও রাওয়া ফ্রাইয়ের মতোই। একই পেস্ট, সঙ্গে নারকোলের দুধ। এই ট্যাংরাভাজা একটা আবিষ্কার। এ সব মাছভাজার সঙ্গতে মিক্সিতে সৃষ্টি রসুন, শুকনো লঙ্কা, ধনেগুঁড়ো, নারকোলের একটা চাটনি। |
|
ম্যাঙ্গালোরে নারকোলের এই আধিপত্যের সঙ্গে লক্ষণীয়, দই, পুদিনা-টুদিনার অনুপস্থিতি। ওই তল্লাটে লইট্যা যেমন হল গিয়ে বম্বে ডাক, ম্যাকারেলের নাম সুরমাই, গুরজালি হল রাওয়াস। তেলাপিয়া তাঁরাও খান। লাল লঙ্কাবাটা, ধনে, জিরে, হলুদ মাখা দিয়ে জমপেশ তাওয়া ফ্রাইটা শুধু পমফ্রেট নয়, তেলাপিয়াতেও দৌড়বে।
চারকোল গ্রিলের আর একটি বিশেষ ম্যাঙ্গালোরিয়ান সৃষ্টি চিকেন সুক্কা। এক ধরনের গা-মাখা। স্কুইড, চিংড়ি, অক্টোপাসেও সুক্কা পেশ করেন প্রদীপ। মাটনেও কিন্তু দারুণ জমবে। প্রদীপের হাতে সুক্কা খেয়ে (যদিও আমিষ) কেমন যেন বাঙালির মোচা-নারকোলের পদটিও মনে পড়ে। শুধুই উগ্র ঝাল নয়, মৃদুতম মিষ্টির প্রলেপও মিশেছে। এই সুখা পদটির উল্টো পিঠে ঝোল বা গাস্সি। লালচে লঙ্কা, রসুন, নারকোলের দুধের সরস রান্না। প্রদীপ পাবদা মাছের গাস্সি খাইয়ে চমকে দিলেন। চিংড়ি বা কোনও মেছো সুক্কার সঙ্গে ম্যাঙ্গালোরের পাতলা ফিনফিনে রুমালের মতো নির দোসার তুলনা নেই। ভেতোদের জন্য গাস্সি চমত্কার।
কলকাতার গড়পড়তা রেস্তোরাঁয় ভেটকি-চিংড়ির বাইরে তো মাছই মেলে না। উজ্জ্বল ব্যতিক্রম বোহেমিয়ান-এর জয়মাল্য বন্দ্যোপাধ্যায়। তেলাপিয়া, পার্শে, পাবদাকে কাঁটামুক্ত করে নানা মৌলিক সৃষ্টিতে মেতেছেন। বেক্ন-ঠাসা তেলাপিয়া, পালংশাক-ঠাসা বোনলেস পাবদা চেরি টমেটো, রাঁধুনি-কাসুন্দিযোগে রান্না হচ্ছে। ফিশ ফিশ নামের মেছো রেস্তোরাঁটিতে আড় মাছের স্টেক, চিতলের শিক কাবাবও জুটছে। কিন্তু দেশের পশ্চিম উপকূলের রান্না কলকাতায় বিরল। ওঁরা আমাদের মতো ফোড়ন দিয়ে সব কিছু এক সঙ্গে ফেলে রাঁধেন না। আমাদের মতো মাছে স্রেফ একটু নুন-হলুদ মাখিয়ে রাখলেই ওঁদের চলে না, সমুদ্রের মাছকে দুর্গন্ধমুক্ত করতে দীর্ঘ ম্যারিনেশনের হাঙ্গামা পোয়াতে হয়। শহরে সরকারি সহায়তায় গঙ্গার বুকে বেড়ানোর বজরা ‘মত্স্যকন্যা অহল্যা’য় যে খানাপিনা আয়োজনের ব্যবস্থা হচ্ছে, প্রদীপ তাতেও বাঙালির নদীর মাছকে একটু আধটু পশ্চিম উপকূলের ঘরানায় রাঁধছেন। কলকাতার বাজারের চেনা মাছে এই স্টাইলটা একটা উপভোগ্য স্বাদবদল ঘটাচ্ছে। |
ছবি: শুভেন্দু চাকী |
|
|
|
|
|