|
|
|
|
|
|
ব্যাগ গুছিয়ে...
|
চুপ চুপ ওই ডুব...
মাঝে জলের ধারে ভেসে থাকা ছোট্ট ছোট্ট শুকনো ডালে
জলফড়িং-এর লাফালাফি। এর মাঝেই বাঁশপাতিটা তার ঠোঁটে
একটা মৌমাছি ধরে এনে হাজির। লেখা ও ছবি অঞ্জন সরকার |
|
এই, দাঁড়িয়ে...দাঁড়িয়ে...চাকা আর এক পাও এগোবে না বন্ধুবর শঙ্করের কড়া শাসানি, সকাল থেকে এক কুচি জলখাবার পেটে ঢোকেনি, এখন বেলা বাজে সাড়ে ন’টা...জলখাবার না নিয়ে এক পাও এগোবো না। অগত্যা থামল গাড়ি, নালিকুলের মোড়ে। নামলাম আমরা। গরম গরম লুচি, ছোলার ডাল আর ছানাপোড়া দিয়ে দুরন্ত জলখাবার। পেট ভরিয়ে, মন চাগিয়ে আবারও চাকা গড়ালো।
আমরা চলেছি নালিকুল ছাড়িয়ে বাসুদেবপুরের দিকে।
|
বুলবুল |
বাঁশপাতি |
|
বাসুদেবপুর কত দূর ভাই? এই তো আর এক-দেড় কিলোমিটার। এগোই আবার। প্রশ্ন করি আবারও একজনকে। এই তো এসে গিয়েছেন বাবু, আর এই এক কিলোমিটার মতো। এ কী রে, এক কিলোমিটার কি আর ফুরোবে না! ফুরোলো সেই রাস্তা। দু’পাশে মাঠ ভরা হলুদ সরষে ফুলেরা সীমন্তিনী। মাঝ বরাবর কালো অ্যাসফেল্টের রাস্তাটা সোজা চলে গেছে। ঝকঝকে রোদে দৃপ্ত সবুজেরা ছায়া দিচ্ছে পথকে...বাঁশপাতিরা লেজ ঝোলাচ্ছে নরম ডালে বসে...ফিঙে নজর রাখছে উঁচু থেকে...। হ্যাঁ ভাই, পাখি কোথায় পাওয়া যাবে?...পাখি? মুরগি? এই তো দু’পা এগোলেই হারুর দোকানে পেয়ে যাবেন... হাসিমাখা উত্তর এল। আরে না রে, মুরগি নয়, যে পাখিরা বিদেশ থেকে আসে। ওঃ! তাই বলেন, একটুখানি এগোলেই পাবেন ‘বলদবাঁধ’, সেখানেই ওই পাখি দ্যাখতে পাবেন। যত দূর জানা আছে, এই জায়গায় আগে ছিল বালির খাদান। খঁড়তে খঁড়তেই জল বেরিয়ে তৈরি এক জলাশয়, চার পাশে বালির প্রাচীর। তখন বলা হত বালির বাঁধ। কী করে যে সে বলদবাঁধে পাল্টালো কে জানে। যাই হোক, এ হেন বলদবাঁধের ধারে এসে দাঁড়ালাম। টলটল করছে জল।
পাড়ে কচুরিপানার দল, জলে গা ভিজিয়ে পিছলানো রোদে চকচকে...গ্রামের বাড়ির দু’চারটে হাঁস গা ভাসিয়েছে জলে... ঠোঁট চালিয়ে পালক পরিষ্কার রাখছে মাঝেমাঝে...নিকানো উঠোনে একমাথা ঘোমটা টেনে দাঁতে আঁচল কামড়ে ঝাড়ু দিচ্ছে যে বৌটি তার চোখে চোখ পড়তেই এক চোখ ভর্ত্সনা...। নীল পালকের চাদর জড়ানো সাদা-বুক মাছরাঙাটার ঠোঁটে গাঙধারা মাছটা ঝটকাচ্ছে। সজনে গাছের তলাটা সাদা হয়ে আছে সজনে ফুলে। বাঁধের জলের মাঝ বরাবর একটা ছোট্ট দ্বীপ। গাছে ঘেরা। একটা ছোট্ট ঘর নজরে এল। আমরা যাব ওই দ্বীপে। পাড়ে বাঁধা আছে এক নৌকা। |
|
সে নৌকা নাকি দ্বীপের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা। ওই দড়ি টেনে টেনে নৌকা বেয়ে নিজেরাই চলে যাওয়া যায়। কিন্তু বিধি বাম। আজ সে দড়ি খোলা। অগত্যা ভরসা ‘ঈশ্বর পাটনী’...। কিন্তু কোথায় সে? আবার তাকাই বৌটির দিকে। এখন তার চোখের ভাষায় খেলা করছে চটুলতা। আমাদের অসহায় ভাব দেখে ভালই মজা পেয়েছে সে। মিনিট পনেরোর অপেক্ষার পরে এলেন তিনি, আমরাও চেপে বসি নৌকোয়। শান্ত জলে বৈঠা পড়ছে। বাঁ হাতে জলের পাড়ে বিশালাক্ষ্মীর মন্দির। একটু পরেই নৌকা ভিড়ল দ্বীপে, উঠে এলাম আমরা। এক দল বুলবুলি আর কমলা কাজল পড়া চোখ নিয়ে শালিকের দল আমাদের স্বাগত জানাল। একটা ‘হোয়াইট ব্রেস্টেড কিংফিশার’ জামরুল গাছটার ডালে বসে লালপানা ঠোঁট পাকিয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে দেখছে আমাদের। দ্বীপটাকে অর্ধেক পাক খেয়ে চলে এলাম জলের একেবারে ধারে। প্রচুর ‘কমন টিল’ আর ‘পোচার্ড’ গা ভাসিয়েছে জলে। ক্যামেরার টেলিফোটো লেন্সে দেখলাম তাদের কেউ কেউ আবার চোখ বুজে ভাসছে, আরামে। |
|
|
মাছরাঙা |
|
কেউ বা খুনসুটি করছে আর একজনের সঙ্গে। একটু পরে আবার দল বেঁধে আকাশে। ওদের খেলা দেখতে দেখতেই আপনার সময় পার হয়ে যাবে। মাঝে জলের ধারে ভেসে থাকা ছোট্ট ছোট্ট শুকনো ডালে জলফড়িং-এর লাফালাফি। এর মাঝেই বাঁশপাতিটা তার ঠোঁটে একটা মৌমাছি ধরে এনে হাজির। ‘বি-ইটার’ নামটা সার্থক। এত ক্ষণে সকালের লুচি হজম। বাকি যা আনা হয়েছিল তা দিয়েই দুপুরের খাওয়া শেষ। তার পর আরও কিছুক্ষণ পাখ-পাখালিদের সঙ্গে। কেউ নেই আপনাকে বিরক্ত করার। তার পর হাঁক পাড়ুন ‘ঈশ্বর’-কে, পার হতে হবে যে। জল ছপছপিয়ে সে এসে হাজির। আপনিও সওয়ারি। জল কাটছে নৌকো...বিকালের আলো নরম। দ্বীপের গাছগুলোয় বাড়ি ফেরা পাখিরা সারা দিনের গল্প শোনাচ্ছে সঙ্গীদের। কান পেতে দিন। মিষ্টি একটা হাওয়া দিচ্ছে। বাঁধের জল ছলাত্-ছল। আপনাকে বিদায় দিতে তার দু’চোখ ছল ছল, বাঁধ মানে না আর। জলের বুকেই জলছবি হল দুটো লাইন “আরও একটু বসো তুমি, আরও একটু বলো।
পথিক, কেন অথির হেন নয়ন ছলছল।”
বাসুদেবপুরের বলদবাঁধ আরও একটা দিনের জন্য আপনার অপেক্ষায়, আবারও। |
কী ভাবে যাবেন
|
ফিঙে |
হাওড়া থেকে তারকেশ্বরের ট্রেনে নালিকুল স্টেশন হয়ে লেভেল ক্রসিং পার করে দশ মিনিটে
বাসুদেবপুর সেখান থেকে পাঁচ-সাত মিনিটে বলদবাঁধ। গাড়িতে দুর্গাপুর রোড ধরে তারকেশ্বরের
রাস্তায় নালিকুল স্টেশনের পর লেভেল ক্রসিং পার করে বাসুদেবপুর হয়ে বলদবাঁধ। |
কী দেখবেন |
চট করে শুধু খাবার আর ক্যামেরার ব্যাগ গুছিয়ে এক দিনের জন্য বেড়িয়ে পড়তে আদর্শ। বাঁধের জলে
পরিযায়ী পাখিদের আনাগোনা, দ্বীপেও অনেক পাখি দেখতে পাবেন। তাদের সঙ্গেই সময় কেটে যাবে। |
কখন যাবেন |
শীতই সব থেকে ভাল সময়। বসন্তেও ভাল লাগবে। তবে বর্ষা আর খুব গরম বাদ দেবেন।
|
|
|
|
|
|
|
|