চিনা প্রধানমন্ত্রী লি কে কিয়াং তাঁহার প্রথম বিদেশ সফরে ভারতে আসিতেছেন আগামী কাল। জার্মানি ও সুইজারল্যান্ড তো বটেই, এমনকী স্থায়ী মিত্র পাকিস্তানের আগেও ভারতদর্শনের মধ্য দিয়া নূতন চিনা প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফরের সূচনা নিঃসন্দেহে তাত্পর্যপূর্ণ। বিশেষত চিনা রাষ্ট্রনীতিতে (এবং বিদেশনীতিতেও) প্রতীকের গুরুত্ব যেখানে অপরিসীম। সফরের পূর্বাহ্ণে ভারতের সহিত চিনের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে ‘মধুর’ বলিয়া উল্লেখ করার মধ্যেও নিশ্চিত ভাবে একটি বার্তা রহিয়াছে, লাদাখে দুই দেশের সীমান্ত-সেনার সাম্প্রতিক মুখোমুখি হওয়ার প্রেক্ষিতে যাহার অনুধাবন প্রাসঙ্গিক। চিনের যে-প্রজন্ম বর্তমানে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী পদে অভিষিক্ত, ১৯৬২ সালের ভারত-চিন সীমান্ত সংঘর্ষের পরেই তাঁহারা সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেন। স্বভাবতই, সীমান্ত-বিরোধ লইয়া প্রবীণদের তিক্ত অভিজ্ঞতার বোঝা তাঁহারা আপন স্কন্ধে বহন করেন না। হয়তো সে কারণেই ছোটখাটো উত্তেজনার উপলক্ষকে আঁকড়াইয়া ধরার পরিবর্তে সেগুলি উপেক্ষা করার উদার নমনীয়তা তাঁহাদের আয়ত্ত।
আর ইহাই বোধ করি একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক রচনার ভিত্তি হওয়া উচিত। সীমান্ত বিরোধ জিয়াইয়া রাখিয়া চিনের সহিত সুপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক স্থাপন করা যে অসম্ভব, তাহা নিশ্চিত। সেই বিরোধটি যে বহুলাংশে উপমহাদেশে সাম্রাজ্যবাদের উত্তরাধিকার, তাহাই বা অস্বীকার করিবে কে? তিব্বতের তত্কালীন শাসকদের সহিত ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের সম্পাদিত সীমান্তরেখা ‘ম্যাকমেহন লাইন’ যে চিন কোনও সময়েই মানিয়া লয় নাই (আফগানিস্তান যেমন মানে নাই পাকিস্তানের সহিত তাহার সীমান্ত ‘ডুরান্ড লাইন’-এর বৈধতা), ইহা স্মরণ রাখিয়া বিরোধটির মীমাংসা করা দরকার। বস্তুত, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখাকে সীমান্ত রূপে শিরোধার্য করার মধ্যেই স্থায়ী নিষ্পত্তির সম্ভাবনা নিহিত। চিনা রাষ্ট্রনেতারাও স্থায়ী মীমাংসার পক্ষপাতী। ভারতের সহিত চিনের সীমান্ত-বিরোধ এখনও নিষ্পত্তি না-হওয়ার মূলে অংশত রহিয়াছে ১৯৬২-র স্মৃতিতাড়িত উগ্র ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও তত্প্রসূত রণোন্মাদনা, একবিংশ শতকের রাষ্ট্রনীতির সহিত যাহা আদৌ সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। চিনের বর্তমান শাসক গোষ্ঠী কিংবা চিনা তরুণ প্রজন্মের মনে কিন্তু সীমান্ত-সংঘর্ষ বা সেই সূত্রে ধূমায়িত উগ্র ভারতবিরোধী মনোভাবের কোনও অবশেষ নাই। বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করিলে নয়াদিল্লির তাই লাভই আছে। এক বার সীমান্ত বিরোধের নিষ্পত্তি হইলে যে উত্তেজনা প্রশমন ঘটিবে, তাহার জেরে দীর্ঘ সীমান্ত বরাবর বিপুল সামরিক প্রস্তুতি ও ব্যয়ভারও বহুলাংশে লাঘব হইয়া যাইবে। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে যে জোয়ার আসিবে (গত বছরেই যাহার পরিমাণ ছিল ৬৬৫০ কোটি ডলার এবং চিনই ছিল ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার), উভয় দেশের অর্থনীতি, সমাজ, প্রযুক্তি ও পরিকাঠামোর উন্নয়নে হাতে-নাতে তাহার সুফল মিলিবে। ‘ব্রিক্স’ (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চিন ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে লইয়া গঠিত আর্থ-রাজনৈতিক জোট) গোষ্ঠীর সদস্য হওয়ার সুবাদে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে যে ঘনিষ্ঠতা ইতিমধ্যেই নানা ক্ষেত্রে দুই দেশকে অচ্ছেদ্য বন্ধনে বাঁধিতেছে, তাহা আরও নিবিড় হইবে। এমনকী পাকিস্তানের সহিত ভারতের সম্পর্কের সমীকরণেও নববিন্যাস দেখা দিবে। চিন-পাকিস্তান মৈত্রী তখন আর ভারতের স্বার্থবিরোধী কোনও বন্দোবস্ত বলিয়া প্রতিভাত হইবে না, বরং গোটা উপমহাদেশেই এই তিন দেশের পারস্পরিক বন্ধুত্ব সামাজিক বিকাশের অনুঘটক হইয়া উঠিবে। প্রাচীন সিল্ক রুট-এর আধুনিক সংস্করণ কারাকোরাম হাইওয়ে দিয়া তখন ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাকও চিন ও পাকিস্তানে চলাচল করিতে পারিবে। এই পথে অগ্রগতিই চিন-ভারত সম্পর্কের যথার্থ উন্নয়নের সুপথ। সে জন্য সীমান্ত সমস্যা এখনই সম্পূর্ণ সমাধান করিয়া ফেলা আবশ্যক, এমন কথা বাস্তবোচিত নহে। কিন্তু সেই সমস্যাটি লইয়া আলোড়ন না করিয়া বরং অন্যান্য ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রসার ঘটানোর চেষ্টাই বিধেয়। |