নামটা হারিয়ে যেতে চলেছে শান্তিনিকেতনের মানচিত্র থেকে।
‘সুবর্ণরেখার মোড়’।
গত প্রায় তিন দশক ধরে বিশ্বভারতীর ছাত্রছাত্রী থেকে পর্যটক সকলের কাছেই জায়গাটার নাম হয়ে গিয়েছে সুবর্ণরেখার মোড়, পুরনো-নতুন বই আর সিডির বিপণি ‘সুবর্ণরেখা’র নাম থেকে। শুক্রবার বিপণিটির মালিককে আগামী ৪ জুনের মধ্যে ঘরটি ছেড়ে দেওয়ার নোটিস পাঠিয়েছেন বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে বিদ্বজ্জন মহলে।
বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের অবশ্য দাবি, জায়গাটি ওই নির্দিষ্ট বিপণিকে ব্যবহার করতে দেওয়ার কোনও আইনসম্মত চুক্তি খুঁজে পাওয়া যায়নি। আগামী দিনে ওই জায়গায় আধুনিক ব্যবস্থা-সমেত কোনও গ্রন্থ-বিপণি করার জন্য নিয়মমাফিক ব্যবস্থা করা হবে। বিশ্বভারতীর এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “যাঁকে কোনও সম্পত্তি লিজ দেওয়া হয়েছে, তাঁর মৃত্যুর পর তা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে ফিরে আসাই নিয়ম। এ ক্ষেত্রেও তাই করা হচ্ছে।” |
২ ডিসেম্বর ১৯৮৪ বিশ্বভারতী প্রাঙ্গণে সুবর্ণরেখার উদ্বোধন হয়। সাপ্তাহিক বুধবার ছুটি ছাড়া সর্বদা খোলা থাকতো ওই দোকান। বিশ্বভারতী প্রকাশিত বইয়ে বিশ্বভারতীর ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষকর্মীদের ২৫ শতাংশ ছাড় দিত ‘সুবর্ণরেখা’। অন্যান্যদের ক্ষেত্রে ছাড় ছিল ১০ শতাংশ। কী ভাবে ওই বিপণিটির প্রতিষ্ঠা সে বিষয়ে মৃত্যুর কিছু আগে ‘বইয়ের দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকারে ইন্দ্রনাথ মজুমদার বলেছিলেন, “তখন অম্লান দত্ত বিশ্বভারতীর ভি সি।... বিশ্বভারতী নাকি একটা ঘর বইয়ের দোকানের জন্য দেবে। অনেকেই কলকাতা থেকে অ্যাপ্লিকেশন করেছে মনীষা, গ্রন্থনিলয় এরকম সব দোকানদারেরা। প্রতাপবাবু (কানুনগো) বললেন, ‘আপনার তো বইয়ের লাইনে অনেক অভিজ্ঞতা, আপনি একটা অ্যাপ্লিকেশন করে দিন।’ তখন আমি গিয়ে অম্লানবাবু আমার পুরনো কাস্টমার, গম্ভীর মানুষ তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, তুমি অ্যাপ্লিকেশন দিয়ে যাও।’...পরে দেখলাম শেষকালে আমার ভাগ্যেই শিকে ছিঁড়ল।” অম্লানবাবু দোকানটির উদ্বোধনেও পৌরোহিত্য করেন।
এ দিন সন্ধ্যায় দোকানে দাঁড়িয়ে ইন্দ্রনাথবাবুর স্ত্রী লক্ষ্মী মজুমদার বলেন, ‘‘এই মুহূর্তে দোকানঘরে কয়েক লক্ষ টাকার বই রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আমি দিশাহারা। কী করবো, কেমন করে করবো ভেবে উঠতে পারছি না। আপাতত বিশ্বভারতীর কাছে কিছু সময় চেয়ে আবেদন করব।” বিশ্বভারতীর নিয়ম-নীতি মেনে বইয়ের বিপণি খোলার জন্য অনুমতি চাইবেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।
‘সুবর্ণরেখা’ বন্ধ হতে চলেছে শুনে বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী যোগেন চৌধুরী বলেন, “আমি বরাবর দেখেছি সুবর্ণরেখার ওই দোকানটিকে ঘিরে একটা সুস্থ সাংস্কৃতিক আড্ডার পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। শান্তিনিকেতনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে বিপণিটি। তাই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বিশ্বভারতী কতৃর্পক্ষের আর এক বার ভাবা উচিত।” অনেকের মতে, সুবর্ণরেখার প্রতিষ্ঠাতা ইন্দ্রনাথ মজুমদারের মৃত্যুর মাত্র কয়েক দিন পরেই তাঁর শোকার্ত পরিবারকে এমন একটা নোটিস পাঠানো শোভনও নয়।
|