সমাজে নারীর স্থান নিয়ে অনেক আলোচনা, সমীক্ষা হয়েছে। অন্য দিকে, ভারতে শিশুর অপুষ্টি নিয়েও বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু দুটোর মধ্যে কোনও যোগসূত্র রয়েছে কি? তা নিয়ে সমীক্ষা করেন প্রিন্সটনের গবেষক ডায়ান কাফি। দেখা গিয়েছে, পরিবারে, সমাজে মায়ের স্থান, প্রতিপত্তির উপর অনেকটাই নির্ভর করে শিশুর পুষ্টি আর স্বাস্থ্য।
’৯০-এর দশকের মাঝামাঝি একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ায় নারীদের সামাজিক অবস্থান শিশুদের স্বাস্থ্যের উপর অনেকখানি প্রভাব ফেলে। এখানে মেয়েরা যে নেহাত অবাঞ্ছিত, তার প্রমাণ মেয়েদের সংখ্যায় দ্রুত হ্রাস। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী প্রতি এক হাজার ছেলে পিছু মেয়েদের সংখ্যা ছিল ৯১৪। আর শিশুরা যে ভুগছে অপুষ্টিতে, তার ইঙ্গিত মেলে স্বাস্থ্যের সমীক্ষায়। সম্প্রতি দেখা গিয়েছে এখানে পাঁচ বছরের নীচের শিশুদের উচ্চতা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত উচ্চতার মাপকাঠির চাইতে অন্তত দু’দাগ কম। গরিব মায়েদের শিশুরা যে অপুষ্ট থাকবে বেশি, তা আশ্চর্য নয়। কিন্তু যেখানে অর্থনৈতিক অবস্থা এক হওয়া সত্ত্বেও মেয়েদের সম্মানে হেরফের হচ্ছে, সেখানেও শিশুদের পুষ্টি বা স্বাস্থ্যে হেরফের হয়? |
তা বুঝতে ভারতের যৌথ পরিবারের দিকে তাকিয়েছেন ডায়ান। ভারতে যদিও ছোট পরিবারের সংখ্যা দিনেদিনে বাড়ছে তবু যৌথ পরিবারও রয়েছে। তৃতীয় জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার (২০০৫-০৬) রিপোর্ট অনুযায়ী পাঁচ বছরের নীচের শিশুদের মধ্যে ১১ শতাংশ যৌথ পরিবারে থাকে। এই পরিবারগুলি পুরুষতান্ত্রিক। মহিলারা পুরুষদের, আর ছোটরা বয়সে বড় সদস্যদের অধীনেই কার্যত থাকেন। বাড়ির বউয়ের স্থান আবার তাঁদের স্বামীর অবস্থানের উপর নির্ভরশীল হয়। আবার বাড়িতে যদি একাধিক পুত্রবধূ থাকে, সেক্ষেত্রে ধরে নেওয়া হয় ছোট বউ সবচেয়ে বেশি নরম এবং বিনয়ী হবে। অনেক পরিবারে তো এখনও বউদের ঘোমটা দেওয়া, মাটিতে বসা এবং শ্বশুর বা বাড়ির অন্য ছেলেদের সামনে কথা না বলাটাই স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া হয়। তবে এর মধ্যেও বাড়ির বড় বউ দেওরদের সামনে অন্তত কিছুটা স্বাধীন থাকতে পারে বা কর্তৃত্ব ফলাতে পারে, কিন্তু ছোট বউয়ের সে উপায়ও নেই। সে হিসেবে ছোট বউদের পারিবারিক অবস্থান বড় বউদের চাইতে নীচে, এমনই ধরা চলে।
জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার রিপোর্টেও দেখা যায় বাড়ির যে কোনও বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বড় বউয়ের মতামতই প্রাধান্য পায়। ছোট বউয়ের মতামতের গ্রহণযোগ্যতা কম। বাড়ির বাইরে সময় কাটানো, বা পাড়ায় ঘোরার ক্ষেত্রেও ছোট বউয়ের গন্ডি অনেক সীমিত। আবার ছোট বউয়ের ‘বডি মাস ইন্ডেক্স’ বড় বউয়ের তুলনায় কম হয়। অর্থাৎ তাদের মধ্যে অপুষ্টি বেশি। গবেষকরা বলছেন, বিয়ের আগে একই রকম শিক্ষা, একই ধরনের পারিবারিক অবস্থান, এমনকী ছোট বউ বেশি শিক্ষিত হলেও সংসারে তাদের অবস্থান প্রায় একই রকম থাকে।
এর প্রভাব পড়ছে সন্তানের উপরে। ডায়ান দেখছেন, গ্রামের একান্নবর্তী পরিবারে ছোট বউয়ের ছেলেমেয়ে বড় বউয়ের ছেলেমেয়েদের থেকে মাথায় ছোট হয়। যখন বিয়ের আগে ওই দুই বউয়ের উচ্চতা বা তাঁদের স্বামীদের উচ্চতার মধ্যে এমন কিছু তফাত থাকে না, তখনও সন্তানদের উচ্চতায় এই হেরফের দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ একই পরিবারে দুই মহিলা সমান উচ্চতার হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র তাঁদের সামাজিক ও পারিবারিক অবস্থানের পার্থক্য হওয়ায় তাঁদের সন্তানদের উচ্চতায় পার্থক্য দেখা যাচ্ছে।
এই ফলাফল বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য ডায়ান এই শিশুদের বাবাদের সম্পর্কেও সম্পূর্ণ তথ্য নিয়েছেন। দেখা গিয়েছে বাবার উচ্চতা, শিক্ষা, রোজগারে হেরফের দিয়েও শিশুর উচ্চতার হেরফের ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। আরও নিশ্চিত হওয়ায় জন্য একই পরিবারের দুই জ্যাঠতুতো-খুড়তুতো ভাইকে পর্যবেক্ষণ করেও একই তথ্য মিলেছে। শিশুর উচ্চতায় যা যা প্রভাব ফেলতে পারে, এমন বহু তথ্য মিলিয়ে দেখার পর গবেষক ডায়ান নিশ্চিত, বড় বউদের ছেলেমেয়েরা ছোট বউদের ছেলেমেয়েদের চাইতে গড়ে উচ্চতায় বেশি হয়। ছোট বউয়ের সন্তান তুলনায় কতটা বেঁটে হবে, সংখ্যাতত্ত্বে ব্যবহৃত একটি নির্দিষ্ট পরিমাপ (স্ট্যান্ডার্ড ডিভিয়েশন) ব্যবহার করে তা নির্দিষ্টও করা যাচ্ছে। সম্প্রতি ‘Ideas for India’ ব্লগে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর গবেষণাপত্রের সারাংশ। |