বেলেঘাটা বি সি রায় শিশু হাসপাতালের পরিকাঠামো উন্নয়নে অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে একটি ব্লাড ব্যাঙ্কও তৈরি করা হবে বলে ২০১১ সালে ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১১-র সেই জুলাইয়ে বি সি রায় হাসপাতালে ৪৮ ঘণ্টায় ২১টি শিশুর মৃত্যু নিয়ে তখন তোলপাড় হয়ে যাচ্ছিল রাজ্য। তার পরে কেটে গিয়েছে প্রায় দু’বছর। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষিত সেই ব্লাড ব্যাঙ্ক তৈরি হয়নি। উল্টে বুধবার ‘মেডিক্যাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া’র হাতে ডাহা ফেল করা থেকে বাঁচতে পরিদর্শকদের সামনে বি সি রায় শিশু হাসপাতাল থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে মানিকতলা কেন্দ্রীয় ব্লাড ব্যাঙ্ককে দেখানো হল হাসপাতালের ‘দ্বিতীয় ক্যাম্পাস’ এবং ‘নিজস্ব’ ব্লাড ব্যাঙ্ক হিসেবে!
বেলেঘাটার বি সি রায় শিশু হাসপাতাল এবং ফুলবাগানে বি সি রায় পোলিও হাসপাতাল মিলে তৈরি হয়েছে ‘বি সি রায় পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউট অফ পেডিয়াট্রিক সায়েন্সেস’। সেই অর্থে পোলিও হাসপাতালই হল শিশু হাসপাতালের ‘দ্বিতীয় ক্যাম্পাস’। সেখানে কী করে মানিকতলা কেন্দ্রীয় ব্লাড ব্যাঙ্ক ‘দ্বিতীয় ক্যাম্পাস’ হয়? রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের জবাব, “বি সি রায় পোলিও হাসপাতালের একটা ব্লাড ট্রান্সফিউশন ইউনিট ছিল। সেটা ৮ মে থেকে আমরা মানিকতলায় স্থানান্তরিত করে দিয়েছি। সেই অর্থে মানিকতলাও বি সি রায় হাসপাতালের ক্যাম্পাস।”
কিন্তু মানিকতলা কেন্দ্রীয় ব্লাড ব্যাঙ্ক তো আদতে রাজ্যের প্রধান এবং পূর্বাঞ্চলের একমাত্র মডেল ব্লাড ব্যাঙ্ক। সেটা কী করে কোনও একটা হাসপাতালের ক্যাম্পাস হবে? কী করেই বা তাকে কলকাতার একটি হাসপাতালের নিজস্ব ব্লাড ব্যাঙ্ক বলে দেখানো যাবে? রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা নির্বিকার গলায় বলেন, “আমাদের প্রতিষ্ঠানকে আমরা যে রকম ভাবে খুশি বানিয়ে দেখাতে পারি। তাতে কারও কিছু বলার থাকতে পারে না। মেডিক্যাল কাউন্সিলের যা সব চাহিদা, তাতে এইটুকু এ দিক-ও দিক না করলে কোনও দিনই কিছুর অনুমোদন পাওয়া যাবে না।”
কী উদ্দেশ্যে স্বাস্থ্য দফতরের এই ‘এ দিক-ও দিক’ করা?
কোনও ক্রমে বি সি রায় হাসপাতালের ‘পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউট’ তকমাটা বজায় রাখা, পেডিয়াট্রিক সায়েন্সেস-এর আরও ১০টি স্নাতকোত্তর আসন ও ‘ডিপ্লোমা ইন পেডিয়াট্রিক মেডিসিন’-এ অন্তত পাঁচটি আসনের অনুমোদন আদায় করে নেওয়া। মেডিক্যাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার নিয়ম অনুযায়ী হাসপাতালের নিজস্ব ব্লাড ব্যাঙ্ক না থাকলে এই অনুমোদন কোনও ভাবেই পাওয়া সম্ভব নয়। অতএব, এমন ‘মিথ্যা’র আশ্রয় নেওয়া ছাড়া গতি নেই স্বাস্থ্য দফতরের সামনে।
এখন প্রশ্ন, ‘বি সি রায় পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউট অফ পেডিয়াট্রিক সায়েন্সেস’ রাজ্যে শিশুদের একমাত্র ‘রেফারাল’ হাসপাতাল। দু’টি ক্যাম্পাস মিলিয়ে প্রায় ৬০০ শয্যার এই হাসপাতালের নিজস্ব ব্লাড ব্যাঙ্ক থাকবে না কেন? কেন মিথ্যার আশ্রয় নিতে হবে?
রাজ্যে শিশু-মৃত্যু আটকাতে গঠিত টাস্ক ফোর্সের প্রধান ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “বললেই কী আর ব্লাড ব্যাঙ্ক করা যায়? অনেক খরচ। তা ছাড়া, জাতীয় এড্স নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বা ন্যাকো-র অনুমতি পেতে অনেক ঝক্কি পোহাতে হয়।” তাঁর আরও ব্যাখ্যা, “আমরা বরং ব্যাঙ্কের বদলে কিছু দিনের মধ্যেই বি সি রায় হাসপাতালে একটি ব্লাড স্টোরেজ ইউনিট করে দেব। অভাবের সংসারে এ ভাবেই চালাতে হবে।”
বি সি রায় হাসপাতালে ভর্তি শিশুদের অনেকেরই অভিভাবক প্রশ্ন তুলেছেন, আর কত দিন মেডিক্যাল কাউন্সিলকে অন্ধকারে রাখা হবে? কত দিন শিশুর রক্তের প্রয়োজনে রাতবিরেতে তাঁদের ছুটে বেড়াতে হবে বিভিন্ন ব্লাড ব্যাঙ্কে? উত্তর জোগায়নি বি সি রায় কর্তৃপক্ষের মুখে। |