চল্লিশ ছুঁই-ছুঁই পৃথা চট্টোপাধ্যায় বুধবার সকালেই ছুটেছিলেন ডাক্তারের কাছে।
পৃথার মা এবং দিদি দুজনেই স্তন ক্যানসারের শিকার। মা মারা গিয়েছেন বছর দশেক আগে। অস্ত্রোপচার করিয়ে দিদি আপাতত সুস্থ। বছর খানেক আগে পৃথা নিজে এক বার ‘ম্যামোগ্রাম’ করিয়েছিলেন। সন্দেহজনক কিছু মেলেনি। কিন্তু এ দিন সকালে অ্যাঞ্জেলিনার অস্ত্রোপচারের খবর জানার পরে স্কুলশিক্ষিকা পৃথার মনে একই সঙ্গে আতঙ্ক এবং প্রশ্ন ঘোরাফেরা করেছে।
আতঙ্কের কারণ, মা ও দিদি আক্রান্ত। তাই তাঁর শরীরেও বংশগত ভাবে ওই রোগের ‘জিন’ থাকতেই পারে। এই কারণেই পৃথার প্রশ্ন যদি সত্যিই তাঁর শরীরে ওই রোগের জিন থাকে, তবে অ্যাঞ্জেলিনা যা করেছেন, সেই পথে হেঁটে কি বাঁচবেন তিনিও?
শুধু পৃথা নন, এই প্রশ্ন এ দিন তোলপাড় তুলেছে বহু মহিলার মধ্যেই। তাঁদের প্রশ্নের সামনে নতুন করে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন ক্যানসার চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরাও। চিকিৎসকদের একাংশের বক্তব্য, বংশগতভাবে যাঁদের শরীরে এই জিন রয়েছে তাঁরা অ্যাঞ্জেলিনার পথ নিলে স্তন বা ডিম্বাশয়ের ক্যানসারে (বুধবার আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘দুই স্তন বাদ দিয়েও নারীত্বের জয়গান’ শীর্ষক প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল, বিআরসিএ১ জিন স্তন ও জরায়ুর সম্ভাবনা বাড়ায়। সঠিক তথ্য হল, ওই জিন স্তন ও ডিম্বাশয়ে ক্যানসারের সম্ভাবনা বাড়ায়) মৃত্যু অনেকটাই ঠেকানো যাবে। আবার অন্য একটি অংশ বলছেন, এটা কোনও পথ হতে পারে না। এই প্রবণতা শুরু হলে এক-এক করে তো সমস্ত অঙ্গই বাদ দিতে হবে!
অস্ত্রোপচার করে অঙ্গচ্ছেদনের পক্ষে রয়েছেন ক্যানসার শল্য চিকিৎসক সৈকত গুপ্ত। তিনি বলেন, “স্তনের চামড়াটা একই রকম রেখে ভিতরে সিলিকন ইমপ্ল্যান্ট করা যেতে পারে। কিংবা পেট বা পিঠের অংশ থেকে টিস্যু নিয়ে তার ভিতরে ভরা যায়। পরিবারে কারও ক্যানসার থাকলে আমরা এখন মহিলাদের জিন-পরীক্ষা অর্থাৎ বিআরসিএ১ পরীক্ষাটা করিয়ে নিতে বলি।” তিনি জানান, চিকিৎসা পরিভাষায় একে বলে ‘প্রিভেনটিভ বাই-ল্যাটারাল ম্যাস্টেক্টমি’।
কিন্তু কত জন রাজি হন এই অস্ত্রোপচারে?
সৈকতবাবু বলেন, “১০ জনকে কাউন্সেলিং করালে এক জন হয়তো জিন পরীক্ষা করাতে রাজি হন। কিন্তু রিপোর্ট পজিটিভ এলেও কেউই অস্ত্রোপচারে রাজি হন না। আসলে এ ব্যাপারে সচেতনতাটাই গড়ে ওঠেনি। অ্যাঞ্জেলিনার নজির সামনে আসার পরে যদি কেউ কেউ উৎসাহী হন, তা হলে সেটাই বড় পাওনা।”
প্লাস্টিক সার্জন মণীশমুকুল ঘোষও অস্ত্রোপচারের পক্ষে। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন তিনি নিজে এমন প্রায় ২০টি অস্ত্রোপচার করেছেন। তাঁর কথায়, “জিনের এই পরীক্ষা এখন এ দেশেও সম্ভব। স্তন ক্যানসারে আক্রান্তের হার যে ভাবে দিন-দিন বাড়ছে, তাতে এটা অন্যতম বিকল্প হয়ে উঠতে পারে।”
কিন্তু অস্ত্রোপচারের খরচ কি সাধারণ মানুষের সাধ্যের মধ্যে?
চিকিৎসকেরা জানান, বিআরসিএ১ ও বিআরসিএ২ পরীক্ষা করাতে খরচ পড়ে ৫০ হাজার টাকা। আর নতুন স্তন তৈরি করতে খরচ এক থেকে দেড় লাখ। চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ মনে করেন, স্তন ক্যানসার হলে তার চিকিৎসা, রেডিওথেরাপি ইত্যাদি মিলিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ হতে পারে। তার সঙ্গে রয়েছে ক্যানসার আক্রান্ত হওয়ার মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণা। তুলনামূলক ভাবে আগাম অস্ত্রোপচার করলে খরচ মোটামুটি তিন লাখের মতো। তুলনায় ডিম্বাশয়ের অস্ত্রোপচারের খরচ আরও অনেক কম। কারণ, স্তনের মতো সেখানে পুনর্গঠনের ব্যাপার নেই।
কিন্তু চিকিৎসকদের আর একটা বড় অংশের আশঙ্কা, প্রয়োজন থাকুক বা না থাকুক, বহু চিকিৎসক এ বার অ্যাঞ্জেলিনার উদাহরণ সামনে রেখে অস্ত্রোপচারে জোর দেবেন। অর্থাৎ, এর বাণিজ্যিকীকরণ ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। ক্যানসার শল্য চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায় বলেন, “অ্যাঞ্জেলিনাকে একটা ব্যতিক্রম হিসেবে ধরে নেওয়াই ভাল। এ দেশে এটা খুব বাস্তবসম্মত নয়। তার চেয়ে যদি রোগটা সম্পর্কে মেয়েরা আরও সচেতন হন, পরীক্ষানিরীক্ষা করান, সেটাই রোগের প্রকোপ কমাবে।”
ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়ও বলেন, “ম্যাস্টেক্টমির পরেও কিন্তু কিছু টিস্যু থেকেই যায়। তা থেকে ফের ক্যানসার হতে পারে। হয়তো স্তনে হল না, বুকের অন্য কোথাও হল। সে ক্ষেত্রে আগেভাগে অস্ত্রোপচার করিয়ে লাভটা কী?” সুবীরবাবুর বক্তব্য, বিআরসিএ-১ এবং বিআরসিএ-২ জিন নিয়ে বেশি চর্চা হচ্ছে। তাই মানুষ সেটা জানতে পারছেন। কিন্তু ক্যানসারের অন্য জিনও রয়েছে। “তেমন হলে তো জিন-ম্যাপিং করে একের পর এক অঙ্গ বাদ দিতে হবে। এটা নিজের উপরে অত্যাচার ছাড়া আর কিছু নয়।”
সুবীরবাবু, গৌতমবাবু দুজনেরই বক্তব্য, প্রথম পর্যায়ে রোগ নির্ণয়টাই জরুরি। তাঁরা বলেন, “গোড়ায় ধরা পড়লে সব ক্ষেত্রে স্তন বাদ দিতে হয় না। শুধু টিউমারটুকু বাদ দিলেও বহু ক্ষেত্রে কাজ হয়। আতঙ্কে দুটো স্তনই অকারণ বাদ দেওয়ার প্রয়োজন কী?”
স্ত্রীরোগ চিকিৎসক সঞ্জীব মুখোপাধ্যায়ও এ ধরনের অস্ত্রোপচারের বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, “নিজের শরীর নিয়ে কেউ যা খুশি করতেই পারেন। কিন্তু আতঙ্কিত হয়ে অস্ত্রোপচার করে অঙ্গ বাদ দেওয়া কোনও রাস্তা হতে পারে না। তা হলে তো প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ ধরা পড়া, ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা, ম্যামোগ্রাম ইত্যাদির প্রয়োজনই থাকত না।”
অ্যাঞ্জেলিনার সূত্র ধরেই এসেছে ডিম্বাশয় বাদ দেওয়ার প্রসঙ্গও। অ্যাঞ্জেলিনা জানিয়েছেন, তিনি পরবর্তী সময়ে ডিম্বাশয় বাদ দেওয়ার কথাও ভাববেন। সৈকত গুপ্তের কথায়, “মেনোপজের পরে ডিম্বাশয় বাদ দেওয়াই যায়।”
আবার সুবীরবাবু পাল্টা বলেন, “এ দেশে ডিম্বাশয়ে ক্যানসারের হার মাত্র ৬ থেকে ৮ শতাংশ। আতঙ্কিত হওয়ার আগে এটাও মাথায় রাখা দরকার।” এ দেশের মেয়েদের মধ্যে স্তন এবং জরায়ুমুখ ক্যানসারের হারই সবচেয়ে বেশি (২৫ শতাংশ)।
|