শরীরে বিআরসিএ-১ জিন ছিল। ওই জিন স্তন আর জরায়ুর ক্যানসারের ঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে দেয়। তাই নিঃশব্দে নিজের দু’টি স্তনই অস্ত্রোপচার করে বাদ দিয়ে দিলেন অ্যাঞ্জেলিনা জোলি।
হলিউডের শীর্ষ নায়িকাদের অন্যতম। সৌন্দর্য আর যৌন আবেদনে সারা পৃথিবীর ঘুম কাড়ার ক্ষমতা রাখেন। ভোগ থেকে ভ্যানিটি ফেয়ার, একাধিক পত্রিকায় বারবার সেরা সুন্দরী নির্বাচিত হয়েছেন। সেই অ্যাঞ্জেলিনা, নিজের স্তন বাদ যাওয়ার কাহিনি নিজেই লিখেছেন মার্কিন সংবাদপত্রে। ঘোষণা করেছেন, “এটা আমার সিদ্ধান্ত। নিজের নারীত্ব এক চুলও কমে গেল বলে মনে করছি না।” তাঁর সাহস ও প্রত্যয়ের সামনে চমকে গেল দুনিয়া। “হিরোইক সিদ্ধান্ত”, বলছেন অ্যাঞ্জেলিনার সঙ্গী, অভিনেতা ব্র্যাড পিট। “গোটা প্রক্রিয়াটা নিজে সামনে থেকে দেখেছি। অ্যাঞ্জেলিনা যা করে দেখাল, ওর মতো আরও যাঁরা এই একই পথ নিচ্ছেন, তাঁরাই প্রকৃত নায়ক।”
একটা বিতর্ক অবশ্য থাকছেই। সেটা হল, শুধুমাত্র ক্যানসার হলেও হতে পারে, এই ভীতিকে সম্বল করেই অঙ্গচ্ছেদনের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত কি? মানতে পারছেন না চিকিৎসকদের বড় অংশ। স্তন ক্যানসার নিয়ে গবেষণারত রিচার্ড ফ্রান্সিস বলেছেন, “বিভিন্ন মানুষের শারীরিক অবস্থার উপর নির্ভর করছে তাঁর চিকিৎসার পদ্ধতি কী হবে। আমার মনে হয়, স্তন ক্যানসার ধরা পড়লে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে তবে অস্ত্রোপচারে করানো উচিত।” কলকাতার নামী ক্যানসার-চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায়ও বললেন, “চিকিৎসক হিসেবে বিষয়টা সমর্থন করছি না। অসুখ না হতেই অস্ত্রোপচার কেন? তা হলে তো জরায়ুও বাদ দিতে হয়!” |
অ্যাঞ্জেলিনা নিজে সেই সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না। জিন-পরীক্ষার রিপোর্ট বলেছিল, স্তন ক্যানসারের সম্ভাবনা ৮৭%, জরায়ু ক্যানসারের সম্ভাবনা ৫০%। নায়িকা নিজেই লিখছেন, “স্তন ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল, তাই আগে ওটার চিকিৎসা করালাম। এ বার দেখি অন্যটা নিয়ে কী করা যায়।”
অসুখ ধরা না পড়তেই এতটা কঠিন পদক্ষেপ কেন করলেন অ্যাঞ্জেলিনা, তার একটা ব্যাখ্যা লুকিয়ে রয়েছে তাঁর জীবন-কাহিনিতেই। জরায়ুর ক্যানসারে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন ৫৬ বছরের মার্শেলিন বারট্র্যান্ড, অ্যাঞ্জেলিনার মা। অসহায় ভাবে দেখা ছাড়া কিছুই করতে পারেননি অ্যাঞ্জেলিনা। এখন তিনি নিজে ছয় সন্তানের মা (তিন জন দত্তক)। মনে একটা ভয় সব সময় তাড়া করত! ক্যানসারের ছোবল তাঁকেও অকালে কেড়ে নেবে না তো ছেলে-মেয়েদের কাছ থেকে? জিন পরীক্ষা করালেন অ্যাঞ্জেলিনা। যা ভয় ছিল তাই। চিকিৎসকরা জানালেন, স্তন ক্যানসারের জন্য দায়ী বিআরসিএ-১ জিন বহন করছেন তিনি। স্তন ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা ৮৭%।
ক্যানসার হলে অনেক সময়ই অস্ত্রোপচার ছাড়া উপায় থাকে না। চিকিৎসার ভাষায় যার নাম ম্যাস্টেকটমি। আটত্রিশের অ্যাঞ্জেলিনা সেই পথে হাঁটলেন আগেভাগেই।
কঠিন নিঃসন্দেহে। সারা পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ পরিবার জানে, কতটা মানসিক লড়াই জড়িয়ে যায় এর সঙ্গে। চিত্রপরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় বলছিলেন, ওঁর এক আত্মীয়ার একটি স্তন বাদ যায়। সারা পরিবারে ছড়িয়ে পড়েছিল সেই বিষাদের ছায়া। “একটা চোখ বাদ গেলেও বিষয়টা ওই রকম দাঁড়াত না কিন্তু। পৃথিবী জুড়েই নারীত্বের ক্ষেত্রে স্তন নিয়ে ভয়ঙ্কর অবসেশন আছে।” বেশ কয়েক বছর আগে এই বিষয়ে ‘শূন্য এ বুকে’ নামে একটি ছবি করেছিলেন কৌশিক। অ্যাঞ্জেলিনার কথা শুনে বললেন, “সারা পৃথিবী অ্যাঞ্জেলিনার শরীরকে সর্বক্ষণ খুঁটিয়ে দেখতে অভ্যস্ত। আশ্চর্য হব না, যদি সেটা ওঁর মধ্যে কোনও বৈরাগ্যের জন্ম দিয়ে থাকে!”
আপাত ভাবে তেমন ইঙ্গিত অবশ্য অ্যাঞ্জেলিনার বয়ানে নেই। তিনি ইতিমধ্যেই ব্রেস্ট ইমপ্লান্ট করিয়েছেন। ক্যালিফোর্নিয়ার পিঙ্ক লোটাস ব্রেস্ট ক্যানসার হাসপাতালে গোটা পর্বটা ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু করে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত চলেছে। তার মধ্যেই ইউনিসেফের প্রতিনিধি হিসেবে ২৬ মার্চ রিপাবলিক অফ কঙ্গো গিয়েছেন। ১১ এপ্রিল লন্ডনের জি-৮ বৈঠকেও হাজির ছিলেন। ওই বৈঠকে অ্যাঞ্জেলিনার সঙ্গে ছিলেন বিদেশমন্ত্রী উইলিয়াম হেগ। জোলির খবরটা জানাজানি হওয়ার পরে হেগ বলেছেন, “ওঁর মতো সাহসী আর পেশাদার মহিলা দেখিনি। এক বারও দেখে মনে হয়নি এত বড় অস্ত্রোপচার হয়েছে।”
অ্যাঞ্জেলিনা জানিয়েছেন, এই কঠিন মুহূর্তে সব সময় পাশে ছিলেন ব্র্যাড পিট। ছিল ছেলে-মেয়েরা। “জানেন, ছোট্ট একটা দাগ ছাড়া কিছু বোঝা যাচ্ছে না। এখন ছেলে-মেয়েদের নিশ্চিন্তে বলতে পারি ভয় পেও না। তোমাদের ছেড়ে যাচ্ছি না।” এবং অত্যন্ত সচেতন ভাবেই খবরটা নিজে পৃথিবীকে জানাতে চেয়েছেন। “কত মেয়ে রয়েছে যাঁদের শরীরে ক্যানসারের জিন রয়েছে অথচ তাঁরা জানেনই না। এই লেখা পড়ে তাঁরা যদি সচেতন হন তা হলেই লাভ।” সচেতন হচ্ছেনও অনেকে। ইন্টারনেটে জমা হচ্ছে মন্তব্য। মেয়েরা বলছেন, সাবাস! অ্যাঞ্জেলিনাকে দেখে অন্যরাও সাহস পাবে, ভরসা পাবে! |