যত সমস্যা সম্মতি নিয়ে। আর তাই আজ, বৃহস্পতিবারই হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে আবেদন জানাবেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনের প্রধান আইনজীবী সমরাদিত্য পাল। দাবি করবেন, পঞ্চায়েত ভোট মামলার নির্দেশ থেকে ‘উভয়পক্ষের সম্মতিক্রমে’ শব্দবন্ধটি বাদ দেওয়া হোক। সেখানে সুবিচার না পেলে তাঁদের সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার সুযোগ থাকছে বলে জানিয়েছে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের একটি সূত্র।
কমিশন সূত্রে আরও জানানো হয়েছে, এই আবেদন জানানো সত্ত্বেও পঞ্চায়েত ভোটের প্রস্তুতি নিয়ে আদালতের নির্দেশ মেনেই চলবে তারা। বুধবারের নির্দেশে হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়েছে, ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে ভোট প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। সে কথা মাথায় রেখে আজ, বৃহস্পতিবার রাজ্যের মুখ্যসচিব ও স্বরাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে বৈঠক করবেন কমিশনের শীর্ষ কর্তারা। পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে তাদের প্রস্তুতি অনেকটাই সারা হয়ে গিয়েছে বলেও এ দিন দাবি করা হয়েছে কমিশনের সূত্র থেকে।
এর জন্য অবশ্য সম্মতি নিয়ে আবেদন করার বিষয়টি আটকাবে না। পঞ্চায়েতের একটি সূত্রের বক্তব্য, সুপ্রিম কোর্টই বলেছে, যে বেঞ্চের রায় নিয়ে বিভ্রান্তি, আবেদন করতে হবে সেখানেই। তাই প্রধান বিচারপতি অরুণকুমার মিশ্রের বেঞ্চেই আজ আবেদন জানাতে যাচ্ছেন তাঁরা।
প্রধান বিচারপতি অরুণকুমার মিশ্র এবং বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর ডিভিশন বেঞ্চ মঙ্গলবার তাদের নির্দেশে জানায়, দু’পক্ষের (অর্থাৎ রাজ্য নির্বাচন কমিশন ও রাজ্য সরকার) সম্মতিক্রমেই পঞ্চায়েত ভোট সংক্রান্ত যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডিভিশন বেঞ্চ। প্রাথমিক ভাবে আদালতের রায়কে স্বাগত জানালেও পরে এই সম্মতির প্রসঙ্গ নিয়ে জলঘোলা শুরু হয়। রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে আইনজীবী সমরাদিত্য পালের বাড়িতে গিয়ে কেন ডিভিশন বেঞ্চের লিখিত নির্দেশে এমনটা লেখা হল, তা জানতে চান। সমরাদিত্যবাবু মীরাদেবীকে জানান, তাঁর কোনও সম্মতি-ই নেওয়া হয়নি। এর পরেই ঠিক হয়, সমরাদিত্যবাবু বিষয়টি সংবাদমাধ্যমকে জানাবেন। এর পরে দফায় দফায় আলোচনার পরে কমিশন সিদ্ধান্ত নেয়, তারা প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চেই নির্দেশ সংশোধন করার আর্জি জানাবে।
কমিশনের দাবি, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আদালতের লিখিত নির্দেশ হাতে পাওয়ার আগে ওই সম্মতির ব্যাপারে কিছুই জানত না তারা। কমিশনের সচিব তাপস রায় এ দিন বলেন, “ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশে উভয়পক্ষের সম্মতি সংক্রান্ত যে কথা লেখা হয়েছে, তার সঙ্গে আমরা সহমত নই। কী ভাবে এটা লেখা হল, তা নিয়ে আমাদের মনে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।” আরও একটি বিষয় নিয়ে কমিশন ধোঁয়াশার মধ্যে রয়েছে বলেও জানান তাপসবাবু। তাঁর বক্তব্য, কমিশন তাদের আবেদনে রাজ্য পঞ্চায়েত আইনের ৪২ নম্বর ধারা বাতিল করার আর্জিও জানিয়েছিল। অথচ হাইকোর্ট কেন তার কোনও নিষ্পত্তি করল না, তা নিয়ে বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছে কমিশন। তিনি বলেন, “আমরা এ ব্যাপারেও মামলা করার বিষয়ে আলোচনা করছি।” কোথায়, কী ভাবে মামলা করা হবে, সে বিষয়ে অবশ্য এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি কমিশন।
সমরাদিত্যবাবু সচরাচর সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খোলেন না। মঙ্গলবার তিনি এই ভাবে মুখ খোলায় তাঁর আইনজীবী সতীর্থরা বিস্মিত। বুধবার সমরাদিত্যবাবু বলেন, “কোনও আইনজীবী তাঁর মক্কেলের অনুমতি না নিয়ে কোনও মামলায় সম্মতি দিতে পারেন বলে আমার জানা নেই। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আদালত আমার কাছে সম্মতি চাইলে আমি আমার মক্কেল নির্বাচন কমিশনকে তা জানাতাম। তাদের কাছ থেকে সম্মতিপত্র এনে আদালতকে দিতাম। তার পরেই নির্দেশে ‘উভয়পক্ষের সম্মতিক্রমে’ কথাটি লেখা যেত।”
কমিশনের প্রধান আইনজীবী আরও বলেন, “লিখিত সম্মতি না থাকলে এই রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলায় দু’পক্ষের সম্মতিতে রায় হয়েছে এ কথা বলা অনুচিত। সংবাদমাধ্যমের কাছে আমি সচরাচর মুখ খুলি না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমাকে স্বেচ্ছায় মুখ খুলতে হয়েছে। কারণ, প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে মঙ্গলবার আসলে কী হয়েছিল, তা মানুষকে জানানোর দরকার ছিল।”
বুধবার ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশ নিয়ে কমিশনের কর্তারা আলোচনায় বসেন। ডিভিশন বেঞ্চের ওই নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে, মূলত তা নিয়ে আলোচনা হয়। কমিশন সূত্রের খবর, কারও কারও অভিমত ছিল, কমিশন সরাসরি সুপ্রিম কোর্টে যাক। রাজ্য পঞ্চায়েত আইনের ৪২ ধারা বাতিল করা নিয়ে কলকাতা হাইকোর্ট কোনও রায় না দেওয়ায় সুপ্রিম কোর্টে যাওয়া হবে কি না, তা নিয়ে মঙ্গলবার থেকেই আলোচনা করছিল কমিশন।
‘উভয়পক্ষের সম্মতি’-র বিষয়টিকেও যুক্ত করার পরামর্শও দেন কেউ কেউ। শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়, প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চকেই তাদের ভুল শুধরে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হোক।
ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশকে প্রাথমিক ভাবে স্বাগত জানিয়েছিল বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিও। কিন্তু কমিশনের মত জানার পরে প্রক্রিয়া নিয়ে ফের কিছু ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছে প্রধান বিরোধী দল সিপিএম। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, “কমিশনের আইনজীবী সমরাদিত্য পাল মন্তব্য করেছেন, তাঁদের সহমতে নির্দেশ দেওয়া হয়নি। তাই ফের ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।” তাঁর অভিযোগ, “এখন মনে হচ্ছে, শাসকদল নিজেদের শর্তে পঞ্চায়েত নির্বাচন করাতে চাইছে!” তাঁর আরও বক্তব্য, “কাল মনে হয়েছিল মেঘ কেটে গেল! কিন্তু বুধবার যা ঘটছে, তাতে মনে হচ্ছে ফের মেঘ জমছে! মন্ত্রীরা মঙ্গলবার যখন মিষ্টি খাচ্ছিলেন, তখন কোচবিহারে তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা তাণ্ডব চালিয়েছে। তারা বোধহয় বার্তা পেয়ে গিয়েছে, কেন্দ্রীয় বাহিনী ইত্যাদি আসবে না।”
বিচারপতি বিশ্বনাথ সমাদ্দারের কাছে রাজ্য পঞ্চায়েত আইনের ৪২ নম্বর ধারাটি বাতিল করারও আবেদন জানিয়েছিল কমিশন। কিন্তু তিনি তো বটেই, পরে ডিভিশন বেঞ্চও এই নিয়ে কিছু উচ্চবাচ্য করেনি। এই নিয়ে কমিশন সুপ্রিম কোর্টে যাবে কি না, তা নিয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি কমিশন। তবে বিজেপি বুধবার বিষয়টি নিয়ে আদালতে সরব হয়েছে। বিচারপতি সমাদ্দার জানিয়েছিলেন, তিনি শুক্রবার যে রায় দিয়েছেন, তা বিজেপি-র মামলার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বুধবার বিজেপি-র আইনজীবী কৌশিক চন্দ বিচারপতি সমাদ্দারের ওই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে একটি আপিল মামলা দায়ের করেছেন। প্রধান বিচারপতি অরুণকুমার মিশ্র ও বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী এই আপিল মামলা বিচারের জন্য গ্রহণ করেছেন।
|