রাজ্য সরকার ও রাজ্য নির্বাচন কমিশন, দু’পক্ষের সম্মতির কথা বলে ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে পঞ্চায়েত ভোটের প্রক্রিয়া শেষ করার নির্দেশ দিল কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ। আদালতের এই রায়ে রাজ্য সরকার খুশি। কমিশন গোড়ায় সন্তুষ্ট বলে জানালেও রাতে সেই অবস্থান থেকে সরে এসেছে। হাইকোর্টের নির্দেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়া যায় কি না, সে ব্যাপারে ভাবনাচিন্তা চলছে বলেও কমিশন সূত্রে খবর।
প্রধান বিচারপতি অরুণকুমার মিশ্র এবং বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর ডিভিশন বেঞ্চ এ দিন জানিয়ে দিল, ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে রাজ্যে তিন দফায় পঞ্চায়েত নির্বাচন করতে হবে। তিন দিনের মধ্যে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করেই ভোটের দিনক্ষণ ঠিক করবে রাজ্য সরকার। |
কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে রাজ্য সরকার ও নির্বাচন কমিশনের মধ্যে যে বিরোধ ছিল, তা মেটাতে এ দিন নতুন সূত্রও দিয়েছে ডিভিশন বেঞ্চ। রাজ্যে কতগুলি অতি-স্পর্শকাতর, স্পর্শকাতর এবং কম স্পর্শকাতর বুথ রয়েছে, সোমবারেই তা নির্বাচন কমিশনকে জানাতে বলেছিল আদালত। এ দিন সেই তালিকা পাওয়ার পরে ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়ে দিল, কোন বুথে কত সশস্ত্র বাহিনী নিয়োগ করতে হবে। জানিয়ে দেওয়া হল, ভোট কেন্দ্রের বাইরেও পর্যাপ্ত বাহিনী লাগবে। বিচারপতি বিশ্বনাথ সমাদ্দার তাঁর রায়ে জানিয়েছিলেন, কমিশন যে পরিমাণ কেন্দ্রীয় বাহিনী চাইছে (আটশো কোম্পানি), তার ব্যবস্থা করতে হবে রাজ্যকে। কিন্তু এ দিনের রায়ে ডিভিশন বেঞ্চ বাহিনী নিয়ে কার্যত রাজ্যের অবস্থানকেই অগ্রাধিকার দিল। নির্দেশে জানানো হল, ২০০৮ সালে যে ভাবে নিরাপত্তা বাহিনী নিয়োগ করা হয়েছিল, সেই পদ্ধতি এ বারও মানা হবে। বাহিনী কম পড়লে প্রয়োজনে কেন্দ্র বা ভিন রাজ্য থেকে তা আনতে পারবে রাজ্য। অর্থাৎ, কেন্দ্রীয় বাহিনী আনার ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা রইল না। পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, “তিন দফায় ভোট হওয়ার ফলে বাহিনীর চাহিদা কমবে। তবে কিছু বাহিনী পাশের রাজ্য থেকে আনতে হবে। সব দিক খতিয়ে দেখে তার পর কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হবে।” |
বস্তুত, কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে প্রথম থেকেই দু’পক্ষ নিজেদের অবস্থানে অনড় ছিল। এ দিন ডিভিশন বেঞ্চ যে হিসেব করে দেয়, তাতে এ নিয়ে আর কোনও সমস্যা রইল না বলেই মনে করা হচ্ছে। রাজ্যে বুথের সংখ্যা ৫৭ হাজার। তাকে চার ভাগে ভাগ করেছে ডিভিশন বেঞ্চ অতি স্পর্শকাতর, স্পর্শকাতর, কম স্পর্শকাতর এবং সাধারণ। দেখা যাচ্ছে, ৫৮ হাজারের মধ্যে ৩২ হাজার বুথকেই কমিশন অতি-স্পর্শকাতর বলেছে। ডিভিশন বেঞ্চ কমিশনের বক্তব্যকে মান্যতা দিয়ে সেই সব বুথের জন্য দু’জন করে সশস্ত্র ও সাধারণ কনস্টেবলের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিয়েছে।
আদালতের নির্দেশ জানার পরে আইনজীবী সমরাদিত্য পালের বাড়িতে গিয়েছিলেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে। সেখানে তিনি স্পষ্টতই বুঝিয়ে দেন, রায়ে অসন্তুষ্ট কমিশন। হাইকোর্টের নির্দেশনামায় দু’পক্ষের সম্মতির কথাও বলা আছে। কিন্তু প্রথমে মীরাদেবী, পরে সমরাদিত্যবাবু দু’জনেই জানিয়ে দেন, সম্মতি দেওয়া হয়নি। তবে নির্দেশনামায় সম্মতির কথা বলা থাকায় এর বিরুদ্ধে তাঁরা যে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করতে পারবেন না, তা-ও স্পষ্ট করে দেন সমরাদিত্যবাবু। তিনি অবশ্য একই সঙ্গে বলেছেন, “নির্বাচনী পদ্ধতি যেমন চলছে চলুক। আমরা কয়েকটি আইনগত বিষয় নিয়ে পরে আদালতের ব্যাখ্যা চাইব।” কমিশন সূত্রে বলা হয়েছে, ভোটের আগে মানুষের মন থেকে ভয় দূর করতেই কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়েছিল কমিশন। এই রায় যাতে পরে দৃষ্টান্ত না হয়, সে জন্য তাই ভোট প্রক্রিয়া চলার পাশাপাশি তাঁরা সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার কথা ভাবছেন।
রায় শোনার পরে প্রাথমিক ভাবে কিন্তু কমিশন জানিয়েছিল, তারা সন্তুষ্ট। আদালতের বাইরে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় এ দিন কমিশনের আইনজীবী লক্ষ্মীচাঁদ বিয়ানি জানান, ডিভিশন বেঞ্চ যে রায় দিয়েছে তাতে তাঁরা সন্তুষ্ট। সরকারি আইনজীবী (জিপি) অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “অনেকে বলছিলেন রাজ্য পঞ্চায়েত নির্বাচন চায় না। কিন্তু প্রমাণ হয়ে গেল রাজ্য নির্বাচন করতে চায়। এই রায়ে আমরা খুশি।”
রাজ্য সরকার যে হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে নেবে, তা জানিয়ে বাগডোগরা বিমানবন্দরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ঠিক সময়ে পঞ্চায়েত নির্বাচন করাতে বরাবরই রাজ্য সরকার উৎসাহী। দার্জিলিং সফরের মধ্যেই তাঁর হাতে আসে হাইকোর্টের নির্দেশের প্রতিলিপি। সন্ধ্যায় তিনি নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক করা নিয়ে বৈঠকে বসেন রাজ্যের মুখ্যসচিব ও স্বরাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে। প্রাথমিক ভাবে দিন ঠিক হলে কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করবে রাজ্য। অন্য দিকে, আদালতের নির্দেশ নিয়ে অসন্তুষ্ট বোঝানো সত্ত্বেও এ দিন স্বরাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে এক দফা কথা বলেন মীরাদেবীও।
কিন্তু হাইকোর্টের রায় নিয়ে অন্য প্রশ্নও উঠেছে। সদ্য রবিবারেই সুব্রতবাবু জানিয়েছিলেন, জুন থেকে অক্টোবর বর্ষার জন্য রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোট করা সম্ভব নয়। তাই পুজোর আগে পঞ্চায়েত নির্বাচন করাতে চায় না রাজ্য। এখন ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে গোটা প্রক্রিয়া শেষ করতে হলে বর্ষার মধ্যেই ভোট হবে। সে নিয়ে রাজ্য কী বলছে? বৃষ্টি নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। বর্ষার জন্য ভোটে যে সমস্যা হবে, তা জানান সুব্রতবাবুও। তবে শেষ পর্যন্ত পঞ্চায়েত নির্বাচন যে সাংবিধানিক সঙ্কট সৃষ্টি হওয়ার আগেই হচ্ছে, তাতে খুশি সুব্রতবাবু।
পঞ্চায়েত ভোট নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে করানোর ব্যাপারে ডিভিশন বেঞ্চ যে সদর্থক মনোভাব নিচ্ছে, সেটা সোমবার তাদের বক্তব্যেই স্পষ্ট হয়ে যায়। ওই দিন সিঙ্গল বেঞ্চের রায়ে স্থগিতাদেশ চেয়ে ডিভিশন বেঞ্চে আর্জি জানায় রাজ্য। তা খারিজ করে দেয় ডিভিশন বেঞ্চ। একই সঙ্গে প্রধান বিচারপতি দু’পক্ষকেই বলেন, “যথাসময়ে ভোট করার জন্য আপনারা হাইকোর্টকে সহায়তা করুন।” জানিয়ে দেওয়া হয়, মঙ্গলবার মধ্যাহ্ন বিরতির আগেই ডিভিশন বেঞ্চ পঞ্চায়েত মামলার নিষ্পত্তি করতে চায়। এ দিন তা-ই হয়েছে। দু’পক্ষের টানাপোড়েনের মধ্যেও মধ্যাহ্ন বিরতির আগেই প্রধান বিচারপতি তাঁর নির্দেশ জানান। এ দিন শুনানির শুরুতেই প্রধান বিচারপতি অরুণ মিশ্র বলেন, তিনি চান নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পঞ্চায়েত ভোট হোক। তার পরে ডিভিশন বেঞ্চ যে রায় দেয়, তা দু’পক্ষের সম্মতি নিয়েই দেওয়া। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ডিভিশন বেঞ্চ দু’পক্ষের মত জানতে চায়।
ঠিক হয়, তিন দফায় ভোট করতে কত নিরাপত্তা কর্মী লাগবে, তা ঠিক করবে কমিশন। প্রশ্নটা কেন্দ্রীয় বা রাজ্য বাহিনীর নয়। কমিশনের চাহিদা মতো বাহিনী রাজ্য জোগাবে। যদি রাজ্যের বাহিনীতে না কুলোয়, তা হলে অন্য রাজ্য বা কেন্দ্র থেকে বাহিনী এনে সেই চাহিদা মেটানো হবে। দেখা যাচ্ছে, সাংবিধানিক পরিকাঠামোর মধ্যে থেকে বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগোনোর যে পরামর্শ সোমবার আদালত দুই বিবদমান পক্ষকে দিয়েছিল, এ দিন তারা নিজেরাই সেই পথে হেঁটেছে। তাতেও মঙ্গলবার দিনের শেষে প্রশ্ন চিহ্ন রয়েই গেল।
|