প্রবন্ধ ২...
প্রতিশোধ নয়, প্রয়োজন গণতন্ত্র রক্ষা করা
ধুর প্রতিশোধ কি একেই বলে? ১৯৯৯ সালের ১২ অক্টোবর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল পারভেজ মুশারফ মিয়া নওয়াজ শরিফের সরকারকে তার নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন। সিংহাসনচ্যুত প্রধানমন্ত্রী প্রথমে দেশের মধ্যেই বন্দি থাকেন। পরে নির্বাসিত হন। তার পর তেরো বছরের বেশি সময় কেটে গিয়েছে। এ বারের সাধারণ নির্বাচনের পরিণাম দেখে মনে হতে পারে, সময়ের চাকা যেন পুরোটাই ঘুরে গিয়েছে। সেই শরিফের এখন তৃতীয় বার দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়া কয়েক দিনের অপেক্ষামাত্র। অন্য দিকে, জেনারেল মুশারফ স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে নির্বাচনের ময়দানে নামবার ইচ্ছা পোষণ করলেও সেই সুযোগ তাঁর হয়নি। দেশে ফিরতে না ফিরতেই তিনি গৃহবন্দি হয়েছেন। তাঁর শাসনকালের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে একাধিক সম্ভাব্য মামলা এখন তাঁর সামনে ঝুলছে। ঝুলছে শাস্তির খাঁড়াও।

পাকিস্তান এবং গণতন্ত্র যেন সম্পূর্ণ বেমানান এক জুড়ি। অন্তত কয়েক বছর আগে পর্যন্ত এমনটাই মনে হত। গণতন্ত্রের ভিত যে এখনও সে দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামোতে খুব গভীরতা পেয়েছে— এমনটা বলা যাবে না। তবে এই প্রথম নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানে ক্ষমতা হস্তান্তর হতে চলেছে। তাৎপর্যপূর্ণ বইকি! ছেষট্টি বছরের অধিকাংশ সময়ে যে দেশে উর্দির দাপটই দেখা গিয়েছে, সেখানে এই ঘটনা নজিরবিহীন।
স্থিতিশীল সরকারের আশ্বাস? বিজয়ী নওয়াজ শরিফ।
লাহৌর, ১১ মে, ২০১৩। ছবি: এ এফ পি।
এই নির্বাচনে নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লিগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও সন্দেহাতীত ভাবে দেশের পার্লামেন্ট ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে একক বৃহত্তম দল। এই পরিস্থিতিতে জোট সরকার অনিবার্য হলেও সেই সরকারে শরিফের দলের কথাই আপাতত হবে শেষ কথা। ইতিমধ্যেই শরিফ স্বয়ং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ইমরান খানের সঙ্গে দেখা করে তাঁর দ্রুত আরোগ্য কামনা করেছেন এবং নির্বাচনী প্রচারের সময়ে উদ্ভূত তিক্ততা ভুলে যাওয়ার আবেদন জানিয়েছেন। রাজনৈতিক দিক থেকে এই সাক্ষাৎ গুরুত্বপূর্ণ। এই নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি আসিফ আলি জারদারির পাকিস্তান পিপল্স্ পার্টি (পিপিপি)-র চেয়ে কম আসন পেলেও ইমরানের তেহরিক-ই-ইনসাফ খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে বৃহত্তম দল। প্রধানত মার্কিন ড্রোন হানার বিপক্ষে ওই অঞ্চলের ক্ষোভকে সম্বল করে ও নবীন প্রজন্মের একাংশের সমর্থনের ভিত্তিতে ইমরানের সাফল্য। গত ভোটে তাঁর ঝুলি কার্যত শূন্যই ছিল।

গণতন্ত্রে প্রতিশোধের রাজনীতির জায়গা নেই। গণতন্ত্র আলাপ-আলোচনার, সংলাপের পরিসর তৈরি করে। আইনের অনুশাসনে অতীতের (অন্যায়) কৃতকর্মের শাস্তির ব্যবস্থা হতে পারে অবশ্যই। তবে এ সবই কিছুটা কেতাবি কথা! উদীয়মান গণতন্ত্রের বাস্তব রাজনীতি এই সব কথাকে ততটা আমল দেয় কি?
অথচ তৃতীয় দফায় দায়িত্ব নেওয়ার পর নওয়াজ শরিফের সামনে প্রথম এক বছর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, এ যাবৎ পাকিস্তানে সবচেয়ে স্থায়ী ও স্থিতিশীল প্রতিষ্ঠান সেনাবাহিনী। তাই মুশারফের কৃতকর্মের বিচারের প্রক্রিয়া খুব বেশি দূর গেলে, তিনি সুদীর্ঘ কাল গৃহবন্দি থাকলে বা কার্গিল যুদ্ধ নিয়ে বেশি জলঘোলা হলে সেনাকর্তারা যে নীরব দর্শক হয়ে থাকবেন, এটা মনে করার কারণ নেই। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রপতি আসিফ আলি জারদারি ইদানীং বছরে বার চারেক চিন সফর করেছেন। সেই তুলনায় নওয়াজ শরিফ বিগত বছর তিনেকে চিনা নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ততটা যোগাযোগ রেখেছেন বলে জানা নেই। উল্লেখ্য, ভারতের সাপেক্ষে জিনজিয়াং প্রদেশের ইসলামি আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে, পশ্চিম ও মধ্য এশিয়াতে লভ্য জ্বালানির স্বার্থে এবং সর্বোপরি পাকিস্তানের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের তাগিদে বেজিংয়ের কিন্তু তার পুরনো ও নির্ভরযোগ্য সঙ্গী ইসলামাবাদকে প্রয়োজন। যে কোনও মূল্যে। তৃতীয়ত এ বারের নির্বাচনী প্রচারে যে ভাবে ইমরান এবং কিছুটা পরিমাণে নওয়াজ আমেরিকা-বিরোধী অবস্থানকে প্রকট করেছিলেন, তা ওয়াশিংটনের প্রভূত অস্বস্তির কারণ। অতএব নিজেদের স্বার্থে তারাও পাক সেনাকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছে। চতুর্থত, এই বছরই জারদারির রাষ্ট্রপতিত্বের মেয়াদ শেষ হবে। কিন্তু তার আগে পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্ক পাকিস্তানের গণতন্ত্রের অভিমুখ নির্ধারণে সহায়ক হবে। পঞ্চমত, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ইফতিকার মহম্মদ চৌধুরীর কার্যকালের মেয়াদও আর কয়েক মাস। তাঁর অবসরের পরে পাক বিচারালয়ের অতি সক্রিয়তা এত তীব্র থাকবে কি?

নওয়াজ দায়িত্ব গ্রহণ করলে তাঁর সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ অন্তত চারটি।
এক, দেশের তীব্র আর্থিক সংকটের মোকাবিলা। আই এম এফের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের বিপুল ভারে জর্জরিত পাকিস্তান। বিশ্ব আর্থিক মন্দা থেকে দীর্ঘমেয়াদি মুক্তির পথ এখনও দেখা যায়নি। এই অবস্থায় নওয়াজ কি ওয়াশিংটনের হাত ধরবেন, না বেজিংয়ের? কোটি টাকার প্রশ্ন।
দুই, জ্বালানি তথা বিদ্যুৎ সংকট। পাকিস্তানের বড় শহরগুলির অভিজাত এলাকাতেও ইদানীং দিনে গড়ে দশ থেকে ষোলো ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। ভোটের প্রচারে এই প্রসঙ্গ নওয়াজের দলের পালে হাওয়াও জুগিয়েছে। এ বার, সমাধানের সময়। ইরানের পাইপলাইন না আমেরিকার প্রতিশ্রুতি, কোন পথে এগোবেন নওয়াজ?
তিন, পাক-আফগান সীমান্তবর্তী এলাকা শুধু নয়, পাকিস্তানের বহু অঞ্চলেই যে ভাবে সম্প্রতি ইসলামি উগ্রপন্থী, বিশেষত তেহ্রিক-ই-তালিবান পাকিস্তান-এর মতো সংগঠনের প্রভাব বেড়েছে, তার মোকাবিলা নওয়াজের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। ভুললে চলবে না, জঙ্গি হানায় পাকিস্তানে গত বছর তিনেকে যত মানুষ হতাহত হয়েছেন, সমগ্র বিশ্বে তার তুলনা বিরল।
চার, আঞ্চলিকতাবাদ। নির্বাচনী ফলে এটা স্পষ্ট যে, পাকিস্তানের চারটি প্রদেশে চারটি দলের প্রাধান্য। পঞ্জাবের বাইরে নওয়াজের দলের যেমন আসন প্রায় নেই, ইমরানের দলের আসনও খাইবার পাখতুনখোয়া ও উত্তর পঞ্জাবেই সীমাবদ্ধ। পিপিপি সীমিত সিন্ধু প্রদেশে। বালুচিস্তানে বালুচ জাতীয়তাবাদী দল। যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থাকে ফিরে দেখার গুরুত্ব পাকিস্তানে আজ অনেক বেড়েছে। পাকিস্তানে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎও তার সঙ্গে বিশেষ ভাবে সম্পর্কিত।

রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.